মাঠে মাশরাফিরা জিতুক, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা জিতি

‘খেলাধুলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না’, এই বাক্যটা হয় কোন মূঢ় নচেৎ বিরাজনীতিকরণপন্থী অতিচতুর লোকের আলাপ। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, সেটা সম্পূর্নভাবে ইতিহাসের গতিবিধির বিরুদ্ধালাপ। দলীয় খেলাগুলোতো বটেই মল্লযুদ্ধের মতো ব্যক্তিগত খেলাধুলাও সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সক্ষমতার প্রতীক। সেই প্রমাণ গ্রিকদের উপাখ্যানে যেমন পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় পারসিক উপাখ্যান কিংবা মহাভারতেও। গ্রিকদের বিজয়ী বীরেরা পেত বীরশ্রেষ্ঠের খেতাব আর তারা যে এলাকা থেকে আসতো সেই এলাকা এই গর্বে বলীয়ান হয়ে অন্যদের থেকে বেশি সম্মানিতবোধ করতো। সে যাই হোক, হরেদরে এই আলাপ সকলেরই জানা, এও জানা যে আধুনিক যুগে হা-রে-রে করে অপরের দেশ আক্রমনের সুযোগ নেই, আর সেটা করলেও নিন্দুকের বাক্যবাণে টেকা দায়। ওদিকে জাতি থেকে রাষ্ট্র, আধুনিক মানুষের পরিচয়ের মূলভিত্তি হওয়াতে অপরের থেকে সেরা হবার মানবজাতির যে চিরন্তন বাসনা সেটা দেখানোর জন্য আন্তরাষ্ট্রীয় প্রতিযোগীতা জরুরি। বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগীতার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক হচ্ছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবল বা ক্রিকেটের মতো দলীয় খেলা।

প্রতিবেশী দেশ হলে, দুইদেশের মধ্যে ঝামেলা থাকলে এই সম্মানের প্রতিযোগীতা দারুন উত্তেজনায় রূপ নেয়। এই উত্তেজনা কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, এতোটাই যে ১৯৬৯ সালে ফুটবল খেলা নিয়ে এল সালভাদর আর হন্ডুরাসের মধ্যে ১০০ ঘন্টা স্থায়ী এক যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। ভারত আর পাকিস্তানের ক্রিকেট দ্বৈরথ গত পঞ্চাশ বছরের উপরে টানা উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এমনকি বিশ্বকাপগুলোতেও সমর্থকদের দাবি থাকে যে, কাপ না পেলেও চিরশত্রুদের হারাতেই হবে।

ভারতের সিরিজ ধরে তৈরি টিভিসি মওকা মওকার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিল বাঁশ দেওয়ার টিভিসি তবে ভব্যতার কতটুকু সীমারেখা মানা হয়েছিল সেটা নিয়ে প্রশ্ন হতেই পারে।

বছর ১৫ আগেও এই দৃশ্যপটে বাংলাদেশ ছিলো না, এমনকি তখন জাতীয় দলের এক পেসবোলার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন যে, খেলোয়াড়ি জীবনে শচীন টেন্ডুলকারকে একবার আউট করতে পারলেই তার মোক্ষসাধন হবে। খেলোয়াড়-ম্যানেজমেন্ট এমনকী সমর্থকরাও সবাই তখন জানতো ফলাফল কি হবে! বছর দশেক আগের বাংলাদেশ তখন দুই-একটা ম্যাচ জিতত আর এখন একেবারে সমানে সমান লড়াই করে টাইগারেরা।

ওদিকে বন্ধুরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী ভারতও একটা সময় ছিল ক্রিকেটের মাঝারি মানের শক্তি যদিও এখন তারা ক্রিকেট বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তারা বিশ্বকাপ জিতেছে, র‍্যাঙ্কিং-এর এক নম্বরে গিয়েছে। বাংলাদেশ যেমন ক্রিকেটের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতিতে উত্তেজিত, ভারতও তাই। আর দুই দেশের মানুষেরই যেহেতু জীবনযাত্রার মান নিচু, গর্ব করার মতো খুব বেশি কিছু যেহেতু তাদের জীবনে নেই তাই জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়েছে ক্রিকেট। কেবল ২২ গজই তাদের তাতিয়ে তোলে, উত্তেজিত করে।

তথ্যপ্রযুক্তি আর যোগাযোগের দারুণ উন্নতিতে (পড়ুন টুইটার ও ফেসবুকের কল্যাণে) এখন মিডিয়া এবং জনতা সমানভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে। ফলে উত্তেজনা একেবারে প্রাচীন গ্রিসের মল্লযুদ্ধের মতো রুপ নেয়। ভারত আর বাংলাদেশের খেলায় সেটা ভয়াবহতম আকারে রুপ নেবে সেটা বলাই বাহুল্য।

গেল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল এমনি এক উপলক্ষ। তাতে আগুনে ঘি ঢালে আরেক উপমহাদেশীর বিতর্কিত আম্পায়ারিং। দুই দেশের সোশ্যাল মিডিয়া সীমা ছাড়ানো কথার যুদ্ধে মাতে। সেখানেই শেষ না, এর জের ধরে বাংলাদেশের মুস্তাফা কামাল আইসিসির প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ পর্যন্ত করেন। এমনকি তার কয়েক দিন পরে ওয়ানডে সিরিজে মুস্তাফিজের মতো অভিষিক্ত তরুণের সাথে খেলার মাঠেই ধাক্কাধাক্কি হয়  ভারতীয় অধিনায়ক অভিজ্ঞ মহেন্দ্র সিং ধোনির। তাসকিনের হাতে ধোনীর কাটা মুন্ডুর মিম, বাংলাদেশের এক বিখ্যাত পত্রিকায় মুস্তাফিজের কাটারে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মাথা টাক দেখানো এবং তারপরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জয়ের প্রান্ত থেকে অবিশ্বাস্য হার ও তার প্রতিক্রিয়ায় নানারকম মন্তব্য ও কার্টুনে সোশ্যাল মিডিয়া বাড়াবাড়ি রকমের উত্তপ্ত হয়ে পড়ে।

মুস্তাফিজের কাটারে বিধ্বস্ত টিম ইন্ডিয়াকে নেড়া করে ঘোল দেওয়াটাই বাকি রেখেছিল স্যোশ্যাল মিডিয়া

বাংলাদেশ এবং ভারত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলবে। ভারত বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হলেও বাংলাদেশ প্রথমবার এই টুর্নামেন্টে সরাসরি খেলছে। তবু সাম্প্রতিক অতীত বলে খেলাটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কে জেতে কে হারে বলা মুশকিল। সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমীরা দারুণ একটা ম্যাচ দেখবেন। উত্তেজনায় পরস্পরকে খোঁচাখুঁচিও করবেন। সেটা খেলার উত্তেজনা আর সৌন্দর্যকেও বাড়াবে।

কিন্তু সীমাটা না ছড়াক। প্রতিযোগীতাটা গালাগালির না হয়ে দক্ষতা আর উইটেরই হোক। খেলার মাঠে মাশরাফিরা যেমন গালাগাল দিয়ে না বরং ভালো খেললেই জিতবে তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াতে গালাগালির বদলে উইট, হিউমারের লড়াই চলুক।  গালিগালাজ দিলে খেলায় যেমন শুধু খেলোয়াড়ের মনোসংযোগের ব্যাঘাত ঘটে তাই না, তাদের শাস্তিও দেয়া হয় তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ার খেলায় গালিগালাজ যারা দেয় তারা শুরুতেই হেরে যায়। গালাগাল বাদ দিয়ে যে প্রতিপক্ষকে আউটউইট আর আউটহিউমার্ড করতে পারবে সেই হবে বিজয়ী।

মাঠে মাশরাফিরা জিতুক, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা জিতি।