সুইডেনে ল্যান্ড করার সপ্তাহ খানেক পরেই ছিল কোরবানির ঈদ। একে নিজের পরিবার থেকে দূরে এসে মন খারাপের চূড়ান্ত! অন্যদিকে প্রায় অপরিচিত এক শহরে নিজের মতো করে সংসার গোছানোর ব্যস্ততার মধ্যেই ঈদ হাজির। ঠিক হলো ঈদ এবং আমার আগমন উপলক্ষ্যে বন্ধুরা ঈদের খাওয়া দাওয়াও আমাদের বাসাতেই সারবেন। যেহেতু সরকারি ছুটিছাটার বালাই নেই, তাই ঠিক হল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঈদ পালনের। আমার উনি সকাল সকালই ইউনিভার্সিটি!
নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া। কিছুই বুঝিনা, তার উপর নতুন সংসার! রান্নাবান্না সব চলছে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বেসিসেছি। সব মিলে এতই টেনশনে ছিলাম যে, আসলে ঈদের উচ্ছ্বাস আলাদা করে বুঝিইনি। যদিও দেশ থেকে আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু, কলিগরা সক্কলেই ফোন করছিল, আর বর বাসায় ফিরেই দিয়েছিল চকচকে ঈদি!
যদিও প্রবাসে বিশেষ করে সুইডেনে কাজের দিনে ঈদ পড়লে কাছাকাছি ছুটির দিনেই সবাই মিলে সেটা পালন করার চল। তাতে অবশ্য মজাই হয়! কয়েকদিন ধরেই উদযাপন করা হয় ঈদ। তবে, অনেকেই আগে থেকে ঈদ উপলক্ষে ছুটি নিয়ে রাখেন।
প্রবাসে ঈদের আসল মজা পেয়েছিলাম পরের বার থেকে। দুনিয়াভরা আত্মীয়-স্বজন, কয়েকজন আছেন সুইডেনেই, অনেকদিন ধরে। তারা ঈদ পালন করেন খুব মজার উপায়ে! এক ঈদে সবাই মিলে একজনের বাসায় চলে আসে আগের দিনেই। অন্য ঈদ সবাই করে আরেকজনের বাসায়। সে এক হুলস্থুল মজা! আগের রাতে সবাই লাইন দিয়ে হাতে মেহেদি পরছে! বড়রা রান্নাবান্নার শেষ মুহূর্তের তদারকির ফাঁকে ফাঁকে এসে মেহেদি পরছে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা, পারস্পরিক উপহার বিনিময়, সব মিলে মনেই হয়না যে প্রবাসে ঈদ করছি।
ঈদের দিন সকাল সকাল নামাজের প্রস্তুতি! ছেলে মেয়ে সবাই অংশ নিতে পারে সেই ঈদের জামাতে। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া এবং ঘুরতে বের হওয়া! বাচ্চারা ঠিক আমাদের ছোট্ট বেলার মত এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছে, মিষ্টি খাচ্ছে, ঈদি নিচ্ছে। বাড়ির সবাই পরিবারের এই আনন্দের মুহূর্তগুলি ফ্রেম বন্দি করতে দল বেধে ছবি তুলছে! আমার বার বার মনে হচ্ছিল আমি যেন সেই ছোট বেলায় ফিরে গেছি। যখন ঈদ মানে সারাদিন যা খুশি তাই করার, যতখুশি ঘোরাঘুরির আনন্দ।
পেশাগত কারণে অনেক বছর একটা ঈদ কেটেছে অফিসেই! অন্য ঈদটাও কেমন করে যেন আসত আর চলে যেত! অনেকদিন পর সুদূর সুইডেনের ঈদে পেলাম সেই ছোট বেলার আমেজ। এখানেই শেষ না, দুপুরে সবাই খাওয়া দাওয়া করতে গেলাম পাশের আরেকজন বাংলাদেশি ভাইয়ের বাড়িতে। সবাই আবার এক সাথে যাওয়া চলে না কারণ এদিকে যে বাসায় সবাই মিলে ঈদ করছি সেখানেও মেহমান আসছে! সব মিলে সে এক ভীষণ আনন্দময় পারিবারিক আবহে ঈদ উদযাপন।
প্রবাসে অবশ্য উদযাপন চলে অন্যভাবেও। সেক্ষেত্রে বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়, পরিচিত কয়েক পরিবার একসাথে হয়ে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে অথবা কমিউনিটি হল ভাড়া করে একসাথে বড় পরিসরে ঈদ পূনর্মিলনী আয়োজন করা হয়। সবাই চাঁদা দিয়ে এবং প্রত্যেক পরিবার একটি বা দুইটি খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। অনেকটা ওয়ান ডিশ পার্টির মত। অনেক বাচ্চারা একসাথে হয় খেলে, আনন্দ করে। এছাড়া ব্যস্ত জীবনে পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের মাধ্যম হয়ে ওঠে এই আয়োজন গুলো।
শুধু ঈদ না, বাঙালি বিভিন্ন দিবস, উৎসব পার্বণ ঘিরেই এ ধরনের আয়োজন জমে ওঠে এবং চলে প্রায় মাস ব্যাপী! প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে কোন না কোন দাওয়াত কারো না কারো বাড়িতে থাকেই। পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ছাড়াও পিঠা উৎসব, থার্টি ফাস্ট, নিউ ইয়ারের মত দিনগুলোও পালিত হয় একই সময়ে। বিশেষ দিন গুলোতে সরকারি ছুটি থাকলে তা হয় সোনায় সোহাগা! এভাবেই প্রবাসে চলে নিজেদের মতো করে ঈদ উদযাপন।