১৮৩১ সালের ৩০ এপ্রিল। রাত দ্বিপ্রহর। বিছানা গুছিয়ে শুতে যাবেন মিস্টার উইগ্রার্ন, এমন সময় নাকে এসে ঢুকলো উৎকট পোড়া গন্ধ। উইগ্রার্ন খানদানি লোক, ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি। বিরক্ত হয়ে জানালা খুলতেই চোখ ছানাবড়া। অদূরেই লর্ড ওয়ালসিংহ্যামের বাড়ির শোবার ঘরের জানালা থেকে বেরোচ্ছে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো কালো ধোঁয়া।
হৈ চৈ হলো, ভৃত্যদের জাগানো হলো। নেভানো হলো আগুন। শোবার ঘরের চিহ্নমাত্র তখন আর অবশিষ্ট নেই। খাটের পুড়ে যেই ছাইয়ের গাদা, তার ওপরেই চিৎ হয়ে আছে লর্ড ওয়ালসিংহ্যামের হলদে-সাদা কঙ্কাল। আগুন থেকে বাঁচতে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন লেডি ওয়ালসিংহ্যাম। ভাঙা হাত-পা আর থার্ড ডিগ্রি বার্ন নিয়ে ভোর অবধি মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে তিনিও হার মানেন।
আগুনে পুড়ে নিঃসন্তান এই অভিজাত দম্পতির ছাই হওয়ার ঘটনা আলোড়ন তোলে ইংল্যান্ডে। তদন্তে শেষমেষ বের হয় আয়েশ করে খাটে শুয়ে বই পড়ছিলেন কর্তা। হয়ত সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বিছানার মাথায় রাখা মোমবাতি থেকেই এই লঙ্কাকাণ্ড! এই ঘটনার পরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ার বিরুদ্ধে এক রকম যুদ্ধই শুরু হয়ে যায়। লর্ড ওয়ালসিংহ্যামের পুড়ে ছাই হওয়া এবং লেডি ওয়ালসিংহ্যামের অনিচ্ছুক সহমরণ রীতিমত ঈশপের নীতিগল্পে রূপ নেয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পত্রিকাগুলোর পাতায় লেখা হয়, প্রার্থনা শেষ করে ঘুমিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে ধর্মগ্রন্থে। সেখানে আগুন মাথায় রেখে বই খুলে আয়েশের এই আকাঙ্ক্ষা, ঈশ্বরের ক্রোধ নিজের ওপর ডেকে আনার নামান্তর।
বিছানায় বই পড়ার অভ্যাসকে সামাজিক কলঙ্কে রূপ দেয়ার এই প্রয়াসের উৎপত্তি কিন্তু ১৮৩১ সালেরও আরো অনেক আগে। বিখ্যাত ব্রিটিশ পন্ডিত স্যামুয়েল জনসনের মৃত্যুর পর, ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত এক জীবনীগ্রন্থে জনসনের বিছানায় শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস ছিলো বলে উল্লেখ করা হয়। এই অপরাধে বইটিতে জনসনকে রীতিমতো ধমকেছেন জীবনীকার, যেমনটা অবাধ্য সন্তানকে ধমকান তিক্ত পিতা। এছাড়া জানা যায়, জোনাথান সুইফটও একবার বিছানায় শিয়রে মোমবাতি রেখে পড়তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। মোম থেকে পর্দায় এবং তা থেকে গোটা ঘরে আগুন ধরে যায়। পরে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেন সুইফট, রেহাই পান কেলেঙ্কারির হাত থেকে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, নেহাত দুর্ঘটনা এড়াতেই সমাজের এই ত্রাহি রব। অথচ ১৮৩৩ থেকে ১৮৬৬ এর অগ্নিকাণ্ডের তালিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, লন্ডনে ২৯ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যার মধ্যে মাত্র ৩৪টির কারণ ছিলো বিছানায় বই পড়ার অভ্যাস। শতকরার হিসাবে এটি শূণ্য দশমিক ১১ শতাংশ।
এর কারণটা একটাই। এই অভ্যাস সমাজে ছিলো নতুন। ছাপাখানা আবিষ্কারের পর বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বই ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে ছড়াতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত একটা বই হাতে নিয়ে বিছানায় যাওয়াটা ছিলো মোহনীয় স্বপ্নে পাওয়া সুযোগের মতো। কারণ এর জন্যে প্রথমত অক্ষরজঙানের দরকার ছিলো, ঘরে বই কিনে রাখতে পারার আর্থিক ক্ষমতার দরকার ছিলো এবং তখনকার সমাজ অনুযায়ী, এমন বিলাসি জীবনব্যবস্থার দরকার ছিলো, যা একাকি নিরিবিলি বই পড়ার সুযোগটা দেয়। এর আগ পর্যন্ত পড়ার ব্যাপারটা ছিলো গোষ্ঠীভিত্তিক, উচ্চস্বরে একজন পড়তো, চারপাশে আগ্রহী শ্রোতারা শুনতো। নীরবে পড়া বা ‘সাইলেন্ট রিডিং’ ছিলো অভাবনীয় ব্যাপার। পড়াশোনার ব্যাপারটা যদি বাদও দেয়া হয়, শোবার ঘর যে একটা সংরক্ষিত, ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় স্থান এমন সংস্কৃতিও তখন গড়ে ওঠেনি। ঐতিহাসিক নথিগুলো ঘাঁটলে দেখা যায়, টিউডর রাজবংশে রাজা বা রাণির বিছানার পাশেই ভৃত্যদের খাট, কোথাও কোথাও প্রবল শীতে রানীর সঙ্গে একই কম্বলে চাকরানীর শুয়ে পড়ার উল্লেখও আছে। অন্যদিকে দরিদ্র কৃষক প্রজাদের ঘরে কক্ষই থাকতো মোটা একটা। তাই সেখানেও গোপনীয়তার কোনো বালাই ছিলো না। বুর্জোয়া পরিবারে একাধিক কক্ষ থাকলেও শোবার ঘর কোনো ব্যক্তিগত স্থান ছিলো না, ছিলো পরিবারের সবার একত্রিত হওয়ার জায়গা।
এই যখন অবস্থা, তখন চার খুঁটিওয়ালা পর্দা-টাঙানো খাটের চল শুরু হয় ইউরোপে। শোবার ঘরে প্রথমবারের মতো ব্যক্তি সীমানা এবং গোপনীয়তার ছোঁয়া লাগে। প্রকাশ্য সামাজিক আচারের তালিখা থেকে ‘ঘুম’-এর নাম কাটা পড়ে তখনই। আর ছাপাখানার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদের তালিকায় যুক্ত হয় বই। আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের যুগের যেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদী দর্শন, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃতির এই নতুন উপাদান।
যেই সমাজ নিজস্বতার বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কোনো তোয়াক্কা করে না, সে সমাজে এই গোপনীয়তার উদ্ভব ছিলো অনেকটা আঁতে ঘা লাগার মতো। বিছানায় বই নিয়ে পড়াটাও তাই। চারপাশে আর দশ জন মানুষ থেকে আলাদা হয়ে একজন চারপাশে পর্দা টাঙিয়ে বই পড়ছে, নিজস্ব জগতে ডুব দিচ্ছে, সেটাকে মোটেই ভালোভাবে নেয়া হয়নি। বলা হলো, বই পড়ো আর যাই করো, একাকি সমাজবিচ্ছিন্ন মুহুর্তগুলোই হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের মূল উৎস। তাই, এই নিরীহ ব্যক্তিগত মুহুর্ত থেকে যদি অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হতো, তাতে খড়গহস্ত হতো সমাজের প্রথাপ্রেমীরা। অনিচ্ছাকৃত দূর্ঘটনা হলেও গোটা ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমনভাবে দেখা হতো, যে এই আগুন নেহাত পাপের শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইন্টারনেটের এই যুগে আজকাল যে ‘গেলো, গেলো’ রব শোনা যায়, সেটার সাথে এই ঘটনাপ্রবাহের ভালো মিল পাওয়া যায়। দুটোই নতুনের আগমনে পুরনো সংস্কৃতির আত্মরক্ষার বর্মের মতো। তবে বই পড়ার অভ্যাস আমলে নিলে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা পরিহাসের মতো লাগবে। সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে সামাজিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, বহু কষ্ট আর অর্থের বিনিময়ে বই জোগাড় করে পড়াটাই ছিলো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
আর বর্তমানে? অন্তর্জাল ভর্তি বইঃ পিডিএফ, ইপাব, মোবি- আর কতো কতো ফরম্যাট। কিন্তু বিছানায় চৌকো এলসিডি স্ক্রিন এবং এক নতুন ‘সামাজিকতার মায়া’য় বাঁধা থাকে চোখ। ওই বিছানায় বইয়ের জায়গা কই?
তথ্যসূত্রঃ
১) https://www.theatlantic.com/technology/archive/2017/05/reading-in-bed/527388/