পকেটভর্তি সালামি

আগে ঈদের সকাল মানেই ছিল সবাই মিলে দলে দলে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। আগে কেন, এখনো ঈদের সকাল মানেই তাই। ঈদের নামাজ পরে কোলাকুলি না করা পর্যন্ত ঈদ যেন ঠিক শুরুই হয় না। আর তারপরই শুরু হতো ছোটদের ঈদের সবচেয়ে আনন্দের পর্ব- বাড়ি বাড়ি টহল দিয়ে পেটপুজো আর পকেটপুজো।

আগে ঈদের দিনে নামাজ শেষ করে ছোটরা দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি ছুটত। একেক বয়সের একেক দল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামি-চাচি-খালাদের বানানো বাহারি রান্না পরখ করে দেখা হতো। এই রান্না পরখ করাতে ছোটদের যতটা আনন্দ ছিল, মামি-চাচি-খালাদের আনন্দ সম্ভবত তারচেয়ে বেশিই ছিল। প্রত্যেক বাড়িতেই অনেকগুলো পদ রান্না করা হতো- সেমাই, পায়েস, ফিরনি, ন্যুডলস, চটপটি, কাবাব, পুডিং, কাস্টার্ড, আরো কত কী! একেক মামি-চাচি-খালা আবার একেক রান্নার বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

ঈদের নামাজের পরেই শুরু হতো ছোটদের সবচেয়ে আনন্দের পর্ব- বাড়ি বাড়ি টহল দিয়ে পেটপুজো আর পকেটপুজো

তবে এই বাড়ি বাড়ি টহলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল পকেটপুজো। পেটপুজোর দায়িত্বে থাকতেন মামি-চাচি-খালারা। আর এই পকেটপুজোর, মানে সালামি দেয়ার দায়িত্বে মামা-চাচা-খালুরা। একেকটা বাড়িতে গিয়ে খাবারের উপর নজর বোলানোর আগেই নজর যেত মামা-চাচা-খালুদের দিকে। তাদের খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পরত তার পায়ের উপর- পা ছুঁয়ে সালাম করতে।

সবাই মুক্তহস্তে সালামি দিলেও, কিপটে ধরনের মামা-চাচা-খালুদের ক্ষেত্রে দাবি-দাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই তাদের পদ-নিষ্কৃতি দিতে হতো

এটা ঠিক সে অর্থে কেতাবি সালাম নয়। আবদারের সালাম। সালামি দেয়ার আবদার। সালামি না দেয়া পর্যন্ত যে সালামের শেষ হয় না। মামা-চাচা-খালুদের হাত সালামির টাকা বের করতে পকেটে ঢুকলেই এই সালাম শেষ করা যায়। অবশ্য অনেক সময় তাতেও এই সালাম শেষ করা যায় না। ওই একটু কিপটে ধরনের মামা-চাচা-খালুদের ক্ষেত্রে আরকি। সেক্ষেত্রে পকেট থেকে হাত কত টাকার নোট বের করল, সেটা দেখে দাবি-দাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই তাদের পদ-নিষ্কৃতি দেয়া যায়।

সালামি দিতে হয় কড়কড়ে নতুন নোট দিয়ে, আর তাই রোযার ঈদে নতুন নোটের বেশ চাহিদাও সৃষ্টি হয়

পেটপুজোর মতো এই পকেটপুজো তথা সালামির শুরুটাও হতো বাসা থেকেই। রোযার ঈদে যেমন নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে নিজের বাসা থেকেই মিষ্টি মুখ করে পেটপুজো শুরু করাটা নিয়ম, তেমনি নামাজ শেষে বাড়ি বাড়ি টহল দেয়ার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে বাসা থেকেই সালামি পাওয়ার বনি হওয়াটাও রীতি। শেষটাও হতো বাসাতেই। শুরু করতেন বাবা-মা, সঙ্গে বড় ভাই-বোন থাকলে তারাও। তারপর একে একে বাড়ির যত বড় আর বুড়ো- সব্বাই। মাঝে ওই পাড়া-প্রতিবেশি মামা-চাচা-খালুরা।

আর শেষটা করতেন বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনরা। এই আত্মীয়-স্বজনের কল্যাণে ছোটবেলার ঈদ যে কত দিন ধরে চলত, শেষই হতে চাইত না। ঈদের পরের কয়েক দিন একের পর এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসত। তাদের কল্যাণে বাড়িতেও ঈদের আবহ জারি থাকত। নিত্যদিন ভুরিভোজের আয়োজন হতো। সেই সঙ্গে জারি থাকত সালামির রীতিটাও। আত্মীয়-স্বজন এলেই ছোটদের প্রথম কাজ পা খুঁজে নিয়ে আবদারের সালাম করা।

আর সেই সালামের অর্থই তো সালামি দিতে হবে। পকেট হাত ঢুকিয়ে চকচকে কয়েকটা কড়কড়ে নতুন নোট বের করে দিতে হবে।