ঢাকার ঈদ উৎসবের ইতিহাস কিন্ত বেশ পুরনো, হয়তো ঢাকা মোঘল রাজধানী হওয়ার থেকেও পুরনো। পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের আগমনের পর থেকেই দুই ঈদ পালিত হয়ে আসছে। মূলত অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সাধারণ জনগণ নিজেরা সেভাবে উদযাপন করতে না পারলেও, উৎসবে শামিল হতে বাধা ছিল না কারোরই। আর বাংলার রাজধানী ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে এবং শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্যে ঈদ, রমজান বা মহররমে উৎসবের আমেজ যে ঢাকায় বেশি ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ উৎসবের নথিবদ্ধ বিবরণ পাওয়া দুষ্কর। মির্জা নাথানের ‘বাহারীস্তান-ই-গায়বী’ (গ্রন্থে বর্ণিত সময়কাল ১৬০৮-১৬২৪)-তে মেলে পূর্ববঙ্গে ঈদের কার্যকলাপের বিবরণ। কিন্তু এর পূর্বেও আফগান-পাঠান শাসকরা যে ঢাকায় ঈদ পালন বা উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল, সেটি ধারণা করা যেতে পারে। কারণ মুসলমান হিসেবে এটি শাসকদের কর্তব্যের মধ্যেই পরতো। তবে মোঘলরা আসার পরে ঈদ যে আরো জাঁকজমকের সাথে পালিত হতে থাকে তা বলাই বাহুল্য।
মির্জা নাথানের বর্ণনাটি ঢাকার না হলেও ধারণা করা যায় যে, ঢাকায়ও একইভাবেই পালিত হতো রমজান ও রোজার ঈদ। রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বয়সীরা বন্ধুবান্ধবের তাঁবুতে জমায়েত হতো, তাদের একসঙ্গে এক শিবিরে থাকাও ছিলো এর অনুষঙ্গ। উল্লেখ্য, ঢাকা তখনো কিন্তু একটি দুর্গ বা কেল্লাকেন্দ্রিক সেনা ছাউনি, তাই এই রীতিগুলো সেখানেও পালিত হওয়া অসম্ভব নয়। শেষ রোজার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা বেশ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিলো তখনো, নতুন চাঁদ দেখা গেলেই বেজে উঠতো তূর্য, শুরু হতো গোলন্দাজ বাহিনীর আতশবাজি ও বন্দুকের গুলি ছোঁড়া এবং তোপ দাগা, চলতো প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত। ঈদের দিন প্রাসাদ বা কেল্লা শিবিরে হতো সারা দিন-রাত খানাপিনা, সুন্দরী গায়িকা ও নর্তকীদের নৃত্য-গীত ও অমাত্যদের আড্ডা। এছাড়াও গরীব ও অভাবীদের মধ্যে বেশ দান-খয়রাত করতেন উচ্চ-পদস্থরা; শ্রমিক বা শিবিরে যারা কাজ করতো তারাও বাদ যেত না।
নির্দিষ্টভাবে ঢাকা শহরে ঈদ উদযাপনের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর গ্রন্থ ‘নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খান’-এ (মুর্শিদকুলী খান ঢাকায় ছিলেন ১৭০০-১৭০২ সময়কালে), যা থেকে ঐতিহাসিক আবদুর রহিম লিখেছেন, তৎকালীন নবাব শুজাউদ্দিনের অধীনে ঢাকার সহকারী শাসনকর্তা শোভাযাত্রা করে দূর্গ থেকে একক্রোশ দূরে, পথে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ছড়াতে ছড়াতে ‘ঈদগাহ’ ময়দানে যেতেন। এই বর্ণনা অবশ্য খানিকটা অতিরঞ্জিত। যা হোক, এই ধানমণ্ডির ঈদগাহ তৈরি হয়েছিল বাংলার সুবাদার শাহ সুজার অমাত্য মীর আবুল কাসেম কর্তৃক, ১৬৪০ সালে। ঐতিহাসিক তায়েশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষেও সেখানে ঈদের জামাতে যেতেন শহরের মুসলমানেরা, তবে তা হয়ে পড়েছিলো জঙ্গলাকীর্ণ। এর সাথে সেখানে তখন একটি মেলার আয়োজনও করা হতো, যাতে যোগ দিতেন ঢাকা ও আশেপাশের লোকজন। ঈদের সাথে আপামর বাংলার সংস্কৃতি মেলাকে সংযুক্ত করে বাঙালী আপন করে নিয়েছিল এ উৎসবকে।
ঢাকার নায়েব নাজিমরা এর সাথে যুক্ত করেন ঈদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণটি, ঈদের মিছিল। যার বেশ কিছু ছবি আছে জাতীয় জাদুঘরে, মহররমের মিছিলসহ মোট ৩৯টি ছবি। ছবিগুলো নওয়াব নুসরাত জঙ্গের আমলে (১৭৮৫-১৮২২) আলম মুসাওয়ার নামের এক শিল্পীর আঁকা। এ মিছিল ঠিক কবে শুরু হয় তা জানা যায়নি, তবে মুনতাসীর মামুনের অনুমান, হয়তো নিমতলীর প্রাসাদে নায়েব নাজিমরা এসে থাকা শুরু করার পরে এর শুরু (নিমতলী প্রাসাদ তৈরির কাজ সম্পন্ন হয় ১৭৬৬-তে)। এই মিছিল নিমতলী প্রাসাদের ফটকের সামনে থেকে, নানা পথ হয়ে, চক ও হুসেনী দালানের সামনে দিয়ে ঘুরে আবার ফটকে এসে শেষ হতো। মিছিলে থাকতো সুসজ্জিত হাওদাসহ হাতি, উট ও পালকি, যার সামনেরটিতে থাকতেন স্বয়ং নায়েব নাজিম। কিংখাবে থাকতো ছাতিবরদার, বাদ্যযন্ত্র হিশেবে কাড়া-নাকাড়া ও শিঙ্গা, আর থাকতো রংবেরঙের নিশান। রাস্তায় ফকিরদের সাথে থাকতো নানা খেলা দেখানেওয়ালারা। আর সারি সারি দর্শক জমায়েত হতো রাস্তার দু’পাশে, বাড়ির ছাদে; দেশীয়, মোঘল বা ইংরেজ সাহেব-মেম কেউ-ই বাদ যেত না। ১৮৪৩ সালে নায়েব নাজিম বংশের বিলুপ্তি ঘটে, তবে এর আগেই হয়তো অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় এ মিছিল। কারণ ১৮২৪ সালে বিশপ হেবার নিমতলী প্রাসাদ জঙ্গলাকীর্ণ দেখে গিয়েছিলেন, সুতরাং নায়েব নাজিমদের অবস্থা তখনই ছিল পড়তির দিকে।
নায়েব নাজিম প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবার পরে, ঢাকার মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দেয় ঢাকার নবাব বলে বিখ্যাত খাজা পরিবার। সে সময় ঢাকা ক্ষয়িষ্ণু শহর, সংকুচিত হয়ে ধানমণ্ডি প্রায় শহরের বাইরে ও জঙ্গলাকীর্ণ; তাই সেখানে ঈদগাহে জামাত হলেও মানুষের আকর্ষণ কমে যায়। ঢাকার প্রধান দুটি ঈদের জামাত তখন হতে থাকে লালবাগ শাহী মসজিদে এবং নবাববাড়ি জামে মসজিদ ও এর প্রাঙ্গণে।
সে সময় ঈদের চাঁদ দেখার জন্যে নবাববাড়ির ছাদই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত। চাঁদ দেখা গেলে নবাববাড়ি থেকে তোপধ্বনি করে মহল্লাতে জানিয়ে দেয়া হতো, এজন্যে নবাববাড়ির পুকুর, গোলতলবের পাড়ে মহল্লাবাসী ভিড় জমাতো। ঈদ উপলক্ষে মেলা বসতো চকবাজার, আরমানিটোলা ও রমনার মাঠে, তাতে জনসাধারণের সাথে আসতেন নবাব পরিবারের সদস্যরাও। ঈদের আনন্দোৎসবে নবাববাড়িতে নাচ-গান হতো, বায়স্কোপ আসার পরে তা দেখার ব্যবস্থাও করা হতো, আবার নাটক-থিয়েটারও আয়োজিত হতো। তবে এসবে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিলো না। এছাড়াও নবাবরাই ঢাকায় সেহেরির সময় গান গাওয়ার প্রচলন করেন বলে কথিত আছে, যা পুরনো ঢাকায় ছড়িয়ে পরে। তারা ঢাকার উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলোতে তারাবী পড়ানোর জন্যে ইমাম নিয়োগ দেন এবং খতম তারাবীর জন্যে হাফেজও নিয়োগ করেন।
এরপরে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের, বিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকের ঈদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন মুনতাসীর মামুন; আশরাফুজ্জামান ও আবদুস সাত্তারের আত্মজীবনীমূলক নিবন্ধের বরাত দিয়ে। তারাও উল্লেখ করেছেন সে সময়ের চকবাজারে এবং রমনা ময়দানে ঈদের মেলার। সেখানের দোকানে থাকতো কাঠের খেলনা, ময়দা ও ছানার তৈরি খাদ্য ইত্যাদি, বাঁশের তৈরি খঞ্চা, ডালা প্রভৃতি আর বিকেলে হতো কাবলীর নাচ।
জেমস টেইলর তার বইয়ে (১৮৪০) শুধু ঈদ না, বরং পুরো রমজান মাসকেই উৎসব বলে অভিহিত করেছিলেন। আসলে ছিলোও তাই, হাকিম হাবিবুর রহমানও তার ১৮৯০-এর দশকের রমজান ও ঈদের বিবরণে এ মতকে সমর্থন দেন। তাই পুরো রোজার মাসের বর্ণনাও ঈদের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। তখন রমজানের শুরুতেই অবস্থাপন্ন লোকদের বাড়িঘর ও সকল মসজিদ পরিষ্কার করে চুনকাম করা হতো। এমনকি একটু গরিবরাও চেষ্টা করতো তাদের বাড়িঘর পরিষ্কার করে মাটি দিয়ে লেপে ঝকঝকে করে রাখতে। ঢাকাবাসী সেহরিতে পছন্দ করতো কোরমা আর শীরবিরঞ্জ (এক রকমের দুধের পায়েস), ভাতের সাথে থাকতো শীরমাল রুটি আর পহেলা রোজাতে অবশ্যই থাকতো কোফতা। ইফতারে ডাল বেটে ফুলুরি তৈরি হতো, মুড়ি ছিলো অত্যাবশ্যক; পেঁয়াজ, তেল, মুড়ি মাখিয়ে খাওয়া হতো, এখনকার মতোই। এগুলোর সাথে থাকতো ফালুদা, আর নানা ধরনের শরবত, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল দুটি- পেস্তা বাদাম ও তোকমার শরবত। এসবের বেশিরভাগ বাড়িতেই তৈরি হতো, কিন্তু বাইরে বাজার থেকে ভুনা চিড়া ও ‘গোলাবি উখরে’ (ধান, ভূট্টার খৈর সাথে মিষ্টি মিশ্রিত একটি খাবার) আসতোই ইফতারে। ধনী-গরীব সকলেই চকে ইফতার কিনতে যেতো ও কিছু না কিছু কিনে নিয়ে আসতো, দুপুর থেকেই তাই সেখানে থাকতো ভীড়। যদিও ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, তবুও একমাত্র চকেই ছিল লখনৌ থেকে আসা আলাউদ্দিন হালুইকরের দোকান (এখন যা আলাউদ্দিন সুইটমিটস), যেখানে লখনৌর হালুয়া, নিমক পারা, শিরমাল ইত্যাদি পাওয়া যেতো।
এ সকল প্রথা ও ঐতিহ্যর অধিকাংশই এখন আর নেই। সেহরি, ইফতার বা ঈদের দিনের খাদ্যতালিকার বেশিরভাগই বর্তমানে বিলুপ্ত। সুবাদার, নায়েব নাজিম বা ঢাকার নবাবরাও এখন ইতিহাস। তবুও ঈদের জৌলুস কমে যায়নি, বরং যুক্ত হয়েছে নানা নতুন মাত্রা, আয়োজন, রংঢং। নতুনভাবে শুরু হয়েছে কাসিদা গাওয়া ও ঈদের মিছিল। এর সাথে চাঁদ দেখা, চানরাতের ফূর্তি, আতশবাজি ফুটানো, ঈদের মেলার মত ঐতিহ্যগুলো তো রয়েছেই।
তথ্যসূত্র :
১। মোঃ আলমগীর, ‘মুসলিম বাংলার অপ্রকাশিত ইতিহাসঃ ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান’, খোশরোজ কিতাব মহল, ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
২। মুনতাসীর মামুন, ‘পুরানো ঢাকাঃ উৎসব ও ঘরবাড়ি’, ‘ঢাকা সমগ্র ১’, অনন্যা, জানুয়ারি, ২০০৩
৩। হাকিম হাবিবুর রহমান, ‘ঢাকাঃ পঞ্চাশ বছর আগে’, প্যাপিরাস সংস্করণ, ২০০৫, অনুবাদকঃ মোহাম্মদ রেজাউল করিম (প্রথম প্রকাশ ১৯৪৫)
৪। Syed Muhammed Taifoor, ‘Glimpses of old Dhaka. A short historical narration of East Bengal and Aassam, with special treatment of Dhaka’, revised and enlarged second edition, 1956
5। মুনতাসীর মামুন, ‘ঢাকাঃ স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ২য় খণ্ড’, অনন্যা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯
৬। James Taylor, ‘A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca’, The Asiatic Society of Bangladesh, March 2010 (1st Edition 1840)
৭। মির্জা নাথান, ‘বাহারীস্তান-ই-গায়বী’, দিব্যপ্রকাশ, জানুয়ারি ২০১২,অনুবাদকঃ খালেকদাদ চৌধুরী (ইংরেজি সংস্করণ ১৯৩৬)
৮। এম এ রহিম, ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃক ইতিহাস (২য় খণ্ড)’, বাংলা একাডেমী, জানুয়ারি ২০১২