হৃদয়বান এক জাপানি কাঠমিস্ত্রির গল্প

সত্তর সালের গল্প।

তাকেজি তাচিবানা-র বয়সও তখন ৭০। বসবাস করেন জাপানের গুনমায়। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। বুড়ো হয়ে গেলেও, কাজ করা থামাননি। কাজ না করলে নাকি ভীমরতিতে ধরবে তাকে।

কাজ না করলে যে তাকেজিকে ভীমরতিতে ধরবে, এটা অবশ্য তার স্ত্রী কিনের বক্তব্য। দুই বুড়োবুড়ির বিয়ের সুবর্ণজয়ন্তী হবে কয়েক বছর পরেই। সেটা বেশ ঘটা করে পালন করারই পরিকল্পনা করছিলেন তারা।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশে) উপকূলে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে

যদিও ঘটা করে উৎসব করার আর্থিক সঙ্গতি তাদের নেই। কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে আর কত-ই বা আয়। তাকেজি নিজেও ভীষণ গরিব ঘরের সন্তান, ছোট্টবেলাতেই নিরুদ্দেশ হওয়া তার বাবা চালাতেন জিনরিকিশা। অনেকটা আমাদের দেশের রিকশার মতোই।

তাকেজির বাবা জিনরিকিশা বা জাপানিজ রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন

সব মিলিয়ে তাকেজির ছোটবেলাটা কেটেছিল ভীষণ অর্থকষ্টে। তাই টাকার মর্ম তিনি বোঝেন। একটুও বাজে খরচ করেন না। এমনকি পড়ন্ত বয়সেও কৃচ্ছসাধনের স্বভাব ত্যাগ করেননি। ঘর গরম রাখতে গ্যাস-বিদ্যুতের বদলে ব্যবহার করেন লাকড়ি। পানি গরম করতেও তাই। একাকী যখন চলাফেরা করেন, কখনোই ট্যাক্সিতে চড়েন না। যত ঝড়ই হোক, বা তুষারই পড়ুক, তিনি নির্দিষ্ট বাসস্টপে বা রেলস্টেশনে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু ট্যাক্সিতে নৈব নৈব চ। নিজের ছেলেমেয়েরাই তাকে খেপায় কিপটে বলে।

এত হিসেবি জীবনযাপন করে কম টাকা জমাননি তাকেজি। সারা জীবনের সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ ইয়েন। স্ত্রী কিন চান একটু ঘুরতে। কিন্তু নিজেদের ব্যস্ততায় সেটাও হয়ে ওঠে না।

পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে জাপানের সে সময়ের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইয়োমিওরি সিম্বুন

এরই মধ্যে জাপানের পত্র-পত্রিকায় খবর বেরোল, ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও তার ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছে। মারা গেছে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করা প্রায় ২০ লাখ মানুষ। অসংখ্য মানুষ ও গবাদি পশু স্রোতের টানে ভেসে গেছে সমুদ্রে। সেই সঙ্গে পাকিস্তান সরকার যে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ায়নি, সে খবরও বেরিয়েছে। বাংলার দুর্গত মানুষের জন্য টাকা তুলতে এমনকি রাস্তায় নেমেছেন এক জাপানি এমপিও। নাম তাকাশি হায়াকাওয়া।

পুরো ঘটনাটি জাপানের মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। অথচ টোকিওর পাকিস্তান এম্বেসির কোনো হোলদোল নেই। কারণ পাকিস্তান সরকারই তো পুরো ব্যাপারটিতে ভীষণ উন্নাসিক, বাংলার মানুষের বাঁচা-মরায় তাদের বয়েই যায়। প্রয়োজনীয় উদ্যোগও জাপানিরা নিজেরাই নিল। হায়াকাওয়ার ত্রাণ তহবিলে মুক্ত হস্তে টাকা দিতে লাগল। যে সব পত্রিকায় ঘূর্ণিঝড়ের খবর ছাপা হয়েছিল, সে সব পত্রিকার অফিসেও দলে দলে লোক এসে টাকা দিয়ে যেতে লাগল।

বাঙালির এই ভয়াবহ দুর্যোগ দাগ কাটে তাকেজির মনেও। তিনি স্ত্রী কিনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করলেন। তারপর নিজের সারা জীবনের পুরোটা সঞ্চয় দিয়ে দিলেন বাঙালিদের সহায়তায় গঠিত একটি ত্রাণ তহবিলে। যে সব পত্রিকা অফিসে ত্রাণ তহবিল খোলা হয়েছিল, তার একটি ছিল ইয়োমিওরি সিম্বুন। পত্রিকাটির টোকিওর গিনজা-র অফিসে এসে তাকেজি সেই ত্রাণ তহবিলে নিজের সারা জীবনের সঞ্চয়, ১০ লক্ষ ইয়েন দিয়ে যান।

ইয়োমিওরি সিম্বুনের টোকিওর গিনজা-র অফিস, অবশ্য পরে এই ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন তোলা হয়েছে

পুনশ্চ : শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই টাকার বেশিরভাগই বাঙালির জন্য ব্যয় করা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এই টাকাও নির্লজ্জভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য চুরি করে। ত্রাণের টাকা দিয়ে কেনা জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতার পর এই তহবিলে থাকা বাকি টাকা বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হলে, তড়িঘড়ি করে জমা থাকা বাকি টাকাও পাঠিয়ে দেয়া হয় রাওয়ালপিণ্ডিতে।