মাত্র ১১ বছরেই মা হয়েছিল মেয়েটি। মামলা না করে, ধর্ষকের শাস্তির দাবি না করে পরিবার আর ধর্মীয় নেতারা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আপসের। বিয়ে হয় শেরির। পাত্র নির্যাতক-ধর্ষক আরেক যুবক। শেরির বয়স তখন ছিল ১১। আর ঘটনাটা বাংলাদেশ কিংবা ভারতে নয়, ঘটেছিল খোদ আমেরিকার ফ্লোরিডার টাম্পার।
আপত্তি জানিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন, যদিও বিয়েটা ঠেকাতে পারেনি তারা। আর দশটি বাল্যবিবাহের মতোই অশান্তির পাঁচালীতে ভরে ওঠে ১১ বছরের শেরির জীবন। এমনকী স্কুলের পড়াটাও শেষ হয়নি তার।
ছোট্ট সেই মেয়েটির গল্প শেষ হয়ে যেতে পারত সেখানেই। যদিও তেমনটা ঘটেনি। শেরি জনসন থেমে থাকেননি, নিজের চারপাশের সবাইকে বাল্যবিবাহের বিষয়ে সচেতন করে চলেছেন অক্লান্তভাবে। আন্দোলন করছেন তার রাজ্য, ফ্লোরিডাতে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের জন্য, যাতে বিয়ের একটি ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারণ করা যায়। প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতোই আজও বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে, বিশেষত ফ্লোরিডায় ১৬ বছর বা তার থেকেও কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। শেরির ঘটনাটাই প্রমাণ করে দিয়েছে শুধু বাংলাদেশ বা তানজানিয়ার মত দেশ নয় বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে ট্রাম্পের আমেরিকাও মুক্ত নয়।
‘আনচেইন্ড অ্যাট লাস্ট’ নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা আমেরিকার ৩৮টি অঙ্গরাজ্যে রেজিস্ট্রি করে হওয়া বিয়েগুলোর উপর এক জরিপ চালায়। যাতে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মাঝে বিয়ে হওয়া মেয়েদের মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার মেয়ের বয়স বিয়ের সময় ১৭ বছরের কম ছিল। আর আলাস্কা, দুই ক্যারোলাইনা এবং লুইজিয়ানায় ১২ বছর বয়সী শিশুদেরও হরহামেশা বিয়ে হচ্ছে। জরিপে আরও উঠে আসে আরকানসাস, আইডাহো আর কেন্টাকিতে প্রচুর মেয়ের মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে হওয়ার ঘটনা। সময়ের সাথে বাল্যবিবাহের হার ক্রমেই কমতে শুরু করলেও আমেরিকার ২৭টি রাজ্যে বিয়ের বয়স বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনই নেই। আর প্রতিটি বাল্যবিবাহে মেয়ের অভিভাবকদের শতভাগ সমর্থন থাকে। যেখানে অধিকাংশ কন্যা শিশুরই বিয়ে হয় তার থেকে অনেক বেশি বয়সী পুরুষের সাথে। সব রাজ্যের পরিসংখ্যান না পেলেও ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আনুমানিক আড়াই লাখ কন্যা শিশু খোদ মার্কিন মুল্লুকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল বলে পরিচিত নিউহ্যাম্পশায়ারের এক গার্লস স্কাউট সদস্য, কাসান্দ্রা লেভেস্কু খোঁজ পায় যে, তার নিজের প্রদেশেও মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে মাত্র ১৩ বছর বয়সে। গার্লস স্কাউটের বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে কাসান্দ্রা উদ্যোগ নেয় তাই একটি নতুন আইন প্রণয়নে জনমত তৈরির। এমনকী স্থানীয় প্রশাসকের সহায়তায় বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ নির্ধারণ করে একটি নতুন প্রস্তাবনাও উত্থাপন করে তারা। সেসময়ই নিউহ্যাম্পশায়ারে ১৫ বছরের আরও দু’জন কন্যাশিশুর বিয়ের ঘটনাও আসে সবার নজরে। যদিও কাসান্দ্রার এই উদ্যোগ সাফল্য পায়নি স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের অসহযোগিতায়। শুধু তাই না, জনসম্মুখে স্থানীয় এক রাজ্যপ্রতিনিধি বাল্যবিবাহ নিয়ে নির্মমভাবে উপহাসও করেন। গার্লস স্কাউটের এই উদ্যোগকে চিরতরে উড়িয়ে দেন রিপাবলিকানরা এবছরের মার্চে, প্রস্তাবটিকে বাতিল ঘোষনা করে।
আরেক অঙ্গরাজ্য নিউজার্সিতে ঘটে অন্য রাজনীতি। অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রনেতারা জোটবদ্ধ হন প্রথম মার্কিন রাজ্য হিসেবে তারা ১৮ বছরের নিচে বিয়েকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করতে। কিন্তু ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এক মাসের জন্যে প্রশাসনিক কার্যক্রমই বন্ধ করে দেন এই উদ্যোগ ঠেকাতে। নিউইয়র্কের প্রশাসনও গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর আপত্তির কারণে সরে আসতে বাধ্য হয় বিয়ের বয়স ১৪ থেকে ১৭ তে উন্নীত করার প্রস্তাবনা থেকে।।
সেভ দ্য চিল্ড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবী জুড়ে প্রতি ৭ সেকেন্ডে গড়ে একটি মেয়ের বিয়ে হয় যার বয়স ১৫ বা তার নিচে। আফ্রিকা বা এশিয়ার মত যুক্তরাষ্ট্রেও বাল্যবিবাহের গোড়া লুকিয়ে আছে ধর্মীয় কুসংস্কারের মাঝে। অধিকাংশ স্থানীয়ই ধর্মীয়ভাবে রক্ষনশীল। আর বিচারকরাও ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক হেজিমনির পক্ষেই রায় দিতে স্বাচ্ছ্বন্দ্য বোধ করেন।
ফ্লোরিডার শেরি জনসন, তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়েদের বিয়ের জন্য একটি সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণে। শেরিকে ধর্ষণ করেছিল যাজক পল্লীর এক সদস্য এবং এক পুরোহিত।
লায়ান্ডাসি ডুয়েট, ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী মেয়েটিও ধর্ষণের শিকার হয় একাধিকবার। রক্ষনশীল খ্রিস্টান পরিবারের মেয়েটিকে মুখোমুখি হতে হয় “বিয়ে” নামক একমাত্র সমাধানের। পরিবারের চাপে সম্মতি দিতে হয় ধর্ষকের বিয়ের প্রস্তাবে। যদিও ডুয়েট ৮ বছর আগে সেই অস্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে কন্যাশিশুদের বিয়েকে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে অপরাধ আর নিজের দেশেই ফ্লোরিডা বা নিউইয়র্কের মত রাজ্যের মানুষই প্রতিনিয়ত নির্বিকার থাকছে সেই একই অপরাধে। দ্বৈতচারিতার কি অপরূপ নিদর্শন!
সূত্র ও ছবি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে