টেমসের পাড়ে, বিগবেনের কাঁধে একফালি কাস্তে মার্কা চাঁদ। ঈদ! বিলেতের গতিময় জীবনে, প্রবাসের কাঠিন্যেও ঈদ আসে। যৌথ পরিবারের ঈদ আনন্দের আগল ভেঙে, একক পরিবারের বাঙালি চলনে দেশে এখনো ঈদের আয়োজন বড় মধুর। যদিও প্রবাসে, দৈবের বশে ঈদের ছুটি বলে আদপে কিছু আছে কি? রোজকার রুটিন মিলিয়ে নেওয়া যাক। দিন ধরে বিলেত প্রবাসীর ঈদের গল্প করা যাক যার দিনটা কাটে যৌথ পরিবারের সকলের সাথে লং ডিসট্যান্স কলে।
ঈদের দিন
সকাল ৫টাঃ ঘুম থেকে ওঠা। দেশে পরিবারের যে যে আছে সবাইকে ফোন করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা। যদি আশেপাশে কোন জামাতের ব্যবস্থা থাকে, (যেটা মাঝেমাঝে ১৫-২০ মাইল দূরেও হতে পারে) সেখানে নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া। ট্যাক্সি ডাকা।
সকাল ৬টাঃ নিজে বা হাতের কাছে বাঙালি যে যে আছে সবাইকে নিয়ে নামাজে যাওয়া। অবশ্য ধারে কাছে নামাজের ব্যবস্থা না থাকলে সোজা সকালের শিফটে কাজে যাওয়া। বিলেতের সকল বাঙালিতো আর ব্রিকলেনে থাকেন না।
দুপুর ১২টাঃ কাজ থেকে ফিরে আসা, যদি শেষ হয়। দেশে আরেকবার কল করা। রাতে নিজের খাওয়ার জোগাড়ে নেমে পড়া। এলাকায় কোন সহৃদয়বান প্রতিষ্ঠিত বাঙালি পরিবার থাকলে তাঁদের ঘরে যেচে নিমন্ত্রণ গ্রহন এবং অত্যুৎসাহে সেটি রক্ষা করা।
বিকাল ৪-৫টাঃ প্রবাসী বন্ধুবান্ধব আত্মজনের সাথে সময় কাটানো, যেটুকু পাওয়া যায়। রাতের রান্নার কাজে সম্ভবত সাহায্য করতে পারবে এমন সকলকে সাথে নিয়ে ঘরে ফেরা।
সন্ধ্যা ৬-৭টাঃ উপস্থিত উৎসাহী জনতার প্রত্যেকের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রান্নায় ঝাঁপিয়ে পড়া।
রাত ১০-১১টাঃ রান্না শেষ। যা হয়েছে (যদি সেটাকে রান্না বলা যায়) নিয়ে সবাই মিলে খেতে বসা। গলে দলা পাকানো পোলাও, ভেতরে মশলা না ঢোকা মুরগির কোরমা। লবন বা মরিচ কম বেশি হওয়া, সেদ্ধ এদিক ওদিক হওয়া গরুর মাংস দিয়ে চোখের পানি আটকে রেখে ঈদ স্পেশাল গ্র্যান্ড ডিনার সম্পন্ন করা। একটু হইহুল্লোরের চেষ্টা (চাপা গলায়, সপ্তাহের মাঝখানে বেশি হট্টগোল হলে পাশের বাড়ি থেকে পুলিশ ডাকবে) এবং পরের দিন সকালের কাজের শিডিউল ধরতে চটপট বিছানায় আশ্রয় নেওয়া। বিছানায় শুয়ে দেশে ফেলা আসা একান্ত আপনার কারোর সাথে ফোনে আরেকদফা আলাপ করতে করতে চোখের পানি ফেলা। পরের ঈদে অবশ্যই একসাথে থাকার অঙ্গীকার করা। জীবনের বাকি সব ঈদ কেমন হবে তার বিস্তারিত প্ল্যান করা।
ঈদের দ্বিতীয় দিনঃ
গতকাল যে ঈদ ছিল সেটা ভুলে রোজকার জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত থাকা। কিভাবে একটা পাউন্ড বেশি বাঁচানো যায়, সেই আঁক কষা।
ঈদের তৃতীয় দিনঃ
ঈদ বলতে যে একটা কিছু ছিল, সেটাই ভুলে যাওয়া।
পঞ্চাশোর্ধ চ্যানেলে ৭দিন ব্যাপী ঈদ অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে বা সারা শহর জুড়ে আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে ভুরিভোজ সারতে যখন ৯ দিনের ছুটি আসলে কয়দিন বা এই ছুটিতে আসলে কি কি করা যেতে পারে সেই হিসেব কষায় ব্যস্ত, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীরা তখন কি করে- এই খবর কজন রাখে? ঈদের বোনাস হাতে নিয়ে ছুটি গুণতে গুণতে বাড়ি যাওয়ার সময়, বিলেতি পরিজনেদের শুধু ঘরে বসে দেশে ফোনে কথা বলার জন্য দুই ঘণ্টা কাজ কম করতে হয়। তাদের কত টাকা বেতন কাটা যায়! ঢাকার বিশাল বিশাল শপিং কমপ্লেক্সে সপরিবার যখন ঈদের কেনাকাটা চলে, তখন কি চিন্তা একবারও চিন্তা করি আমাদেরই মত অনেক পরিবারের একটু বেশি ভালো করে বাঁচার দায় নিতে একজন হাজার মাইল দূরে কত ঘণ্টা ওভারটাইম করে!
না। জানি না। সম্ভবত জানতেও চাই না। নির্মম সত্যটুকু না দেখার ভান করতে যথেষ্ট পটু কিনা, তাই এসব আর গায়েই মাখি না।