ঘাটের কথা

দাদাভাই, এই অষ্টধাতুর আংটি পরলে আপনার চিনি খেতে কোন সমস্যা হবে না। ডায়াবেটিসের জন্য যদি মিষ্টি খাওয়া বারণ হয় তবে মন খারাপ করবেন না। এই আংটিটি ধারণ করুন, আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। লজ্জার কিছু নেই, মাইকের আওয়াজ শুনে ক্যানভাসারের কাছে আসুন, মাত্র কুড়ি টাকায় করুন আপনার সব সমস্যার সমাধান। গুরুর আদেশে এই আংটি নিয়ে আমি ব্যবসা করতে পারি না।

ঘাটের ইলিশ ভাজা সাথে থাকে মরিচ

শতবর্ষ আগের কোন এক কার্তিকে কবিগুরু লিখেছিলেন ‘পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা ঘাটের সোপানে সোপানে পাঠের সুবন্দোবস্ত থাকিত।‘ পুরাতনী কথা নাকি ঘাটের প্রতিটি ধাপের সাথে জলকল্লোলে মিলে কথক ঠাকুরের পারঙ্গমতা অর্জন করে। অধুনা ক্যানভাসারেরাই আমাদের একমাত্র কথক ঠাকুর। তাদের দেখা মেলে কই? ঘাটে।

ঈদে ঘাট থাকে অন্যরকম-সরগরম

ঘণ্টার হিসেব নেই, প্রতীক্ষার শেষ নেই। অজস্র হাঁক-ডাক। ট্রাফিক, আনসার আর উত্তেজিত ঘরমুখো মানুষেরও কমতি নেই। প্রতি ঈদে লাখে লাখে মানুষ বাড়ি ফেরে, এবারে যেমন তারা ফেরির অপেক্ষায় আছেন আষাঢ়ের ভরা পদ্মার তীরে। অবশ্য ঘাট পাড়ি দেওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে উত্তরের মানুষ। উন্নয়ণ এসেছে তাদের দ্বারে। যমুনার জলের সঙ্গে স্থলের আর গলাগলি নেই। তার কালো জল লড়ে কংক্রিটের মজবুত পিলারের সাথে। তীরের ধানখেতের পাশ দিয়ে ভাসে কলমি বন। আপনবেগে পাগল পারা নদীতে ঘূর্ণি ওঠে বাঁকে বাঁকে। জোয়ার-ভাটার টানে টলমল করে জেলে নৌকা।

আধেক ঘুমে স্বপ্নের হদিস খোঁজা

ফেরির গুমোট ভটভটের মাঝে চোখ চলে যায় দূরের জেলে নৌকার দিকে। পাল তোলা ছোট নৌকাগুলো এগিয়ে আসে ফেরির কাছে। দিগন্তে যাদের রাজহাঁস মনে হচ্ছিল তারা এসে ফেরির সাথে গাঁটছড়া বাঁধে, ইলিশের দাম নিয়ে শুরু হয় বাতচিত।

শীতের শীর্ণকায়া না, বর্ষার ভরা পদ্মার সাথে কেবল খেলা করে সোনাঝরা রোদ। কাঁচা সোনার মতো রঙ, চাঁপা ফুলের মতো রঙ সে রোদের। শরতে আবার বয়ে চলা এলোমেলো হাওয়া চরের কাশবনে কাঁপন ধরায় রবিশংকরের গতের মতো।

গুরুর আদেশে সব সমস্যার সমাধান হয় এক আংটিতে

এর মাঝে আসে সোলেমানি খাবনামা আর পুরনো ঈদসংখ্যা হাতে হকার। গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখা শাড়ি পরা ফ্রিদা কাহালুর কথা মনে করে চারুকলার প্রথম বর্ষের রংরুট। নিজেকে দিয়োগো রিভেরা, কিংবা নিদেনপক্ষে রকফেলার মনে হয় তার। ঘাটের আপাত শোরগোলের নিপাট স্থবিরতার মাঝেও তার বুকের মাঝে দ্রুত কাঁপুনি ধরায় তিন সিট আগের মাথা নিচু করে বমি ঠেকানোর চেষ্টা করে চলা কোন এক কলেজ বালিকা। লাইন এগোয়, লাইন ভাঙে। বাসের হেলপারেরা কোন্দল করে, টানা দুই দিন ধরে বাসে ট্রিপের পর ট্রিপ দিয়ে চলা ড্রাইভার স্টিয়ারিং ছেড়ে সিগারেট ধরানোর কথা ভাবে। দূরপাল্লার বাসে বাজে ‘আর কত রাত একা থাকব?’। কেউ ভাবেনা একা থাকাটাই নিয়তি, সতত এই একা থাকা ঘাটটার মতো।