ওপারের ঈদ

উৎসব মানেই উদযাপনের ধুম। আর বাঙালির কাছে ঈদ মানেই উৎসব। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের হিসেব আরেক পাশে রেখে শুধু যদি ওপারের শহর চূড়ামনি অর্থাৎ কলকাতার দিকে নজর দেওয়া হয়, ঈদ কিংবা ইসলামি ঐতিহ্য সেখানে খুব বেশি প্রাচীন কিন্তু নয়। যদিও তাদেরও আছে ঈদ পালনের নিজস্ব রীতি। জব চার্নকের হাতে গড়া ও শহরে ঈদের আমদানি ঘটেছে আওধের লক্ষ্ণৌ থেকে। যদিও বাংলাদেশিদের ঈদের প্রধান শপিং ডেস্টিনেশন কলকাতার এই অর্বাচিনত্বের ইতিহাসের সাথে অধিকাংশেই অপরিচিত।

ব্রিটিশ উপনিবেশের  দৌলতে পত্তন হওয়া কলকাতার অন্যান্য উৎসব যেমন নিজেদের শিকড়ের গল্প সহজেই বলতে পারে, ঈদের ক্ষেত্রে সমীকরণটা ঠিক এক নিরিখে খাপ খায়নি। তার বদলে তুলনায় এককালের মোগল চৌকি হুগলি, মুর্শিদাবাদ অথবা সুলতানি আমলের ঐতিহ্য বয়ে চলা মালদায় ঈদযাপনের আদিগল্প বেশ সমৃদ্ধ। তবে কলকাতাকে গোণার বাইরে ধরবেন, তা হবে না। কারণ ওই লক্ষ্ণৌ কানেকশন। মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ গল্পের শুরুটা করেছিলেন তো!

কলকাতার নাখোদা মসজিদে ঈদের জামাত

অফলাইন বা অনলাইনের ইতিহাস ঘাটলে বলা যায়, লক্ষৌর সৌখিন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সুত্র ধরেই কলকাতায় গড়ে ওঠে প্রথম সংহত মুসলিম বসতি। কলকাতায় তিনি কেবল বসতি নয়, সাথে নিজের শৈল্পিক মানস আর মুসলিম ফেস্টিভিটিতে সিঙ্ক করার মতো অনেক ডুজ অ্যান্ড ডোন্টসেরও বুনিয়াদ তৈরি করে দিয়েছিলেন। ঠুংরি, কাবাবের স্বাদ, মোরগ-লড়াই, হালিমের সুঘ্রাণ, কাবাবের খুশবু, পেল্লাই এক তাওয়ায় ভেসে ওঠা লাচ্ছা পরোটা—শুরু থেকে বর্তমান; তার জন্য নবাবকে ক্রেডিট না দিয়ে উপায় কী?

আমেজটা বোঝা যায় রোজার সময়টাতেই। কলকাতার জায়গায় জায়গায় মিলিয়ে পুরো চেহারাটা শুধু বদলায় তা নয়, বদলে যায় সময়ের গন্ধও। জাদুবাস্তব নয়, রীতিমতো বাস্তব, আর তাতে জুড়ে থাকে সত্যিকারের জাদু। এই যেমন ধরুন নিউমার্কেটে দোকানপাটে কেমন একটা মিষ্টিমতোন ঝিমঝিমে রং ধরে। যতোই ঈদের দিন এগিয়ে আসে, নিউমার্কেট চত্বরে কি চিৎপুর হয়ে ওঠে আরও সরগরম। আর সেই জমজমাট মৌসুমের রঙ তো সবার গায়েই লাগে, ধর্ম-গোত্রের ফারাক কিন্তু ফেস্টিভিটির উপলক্ষকে এতটুকুও নুইয়ে পড়তে দেয় না। এই উৎসব শপিংমলের ব্র্যান্ডে আটকে পড়া নয়, এক কথায় এর ফ্লেভার সুরের আলোর মতোই কলকাতার সবখানে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

সহজ করে বললে সেই কথাটাই আবার বলতে হয়, বাংলার সবখানেই ঈদ হলো মানুষের উৎসব। কোনো গোত্রকরণের জালে তাকে রেস্ট্রিকটেড করার যেমন কোনো মানে হয় না, তেমনি সম্ভবও না। এই উৎসবের স্বাদ, গন্ধ, আনন্দ, উচ্ছাসম আঞ্চলিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে গড়ে তোলে অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এক সেতুবন্ধন। শহর কলকাতায় নবাবের সেই যুগ থেকে আজ অবধি ঈদ সবার জন্য আনন্দের এক গান। সেই সুরে মাতবার এই তো সময়।