ভয় নয় ভিডিও গেমসে

রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে আপনার নাইন-এফ ক্যাব্রিও গাড়িটি। পেছনে সাইরেন বাজিয়ে তাড়া করছে পুলিশ। এই চোর-পুলিশ খেলায় নিজের পিঠ বাঁচাতে গাড়ি তুলে দিলেন ফুটপাথে। চাপা পড়ে মারা পড়লো জনা তিনেক মানুষ। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই পাশের বাইকে চেপে পালালেন আপনি।

হচ্ছে জনপ্রিয় গেম গ্র্যান্ড থেফট অটোর কথা। জনপ্রিয় ভিডিও গেমসগুলোতে যে সহিংস কার্যকলাপ এবং দৃশ্য থাকে, তা বাস্তবেও মানুষকে আরো সহিংস করে তোলে – এই অভিযোগ অনেক দিনের। যদিও চীনের সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, গেমসে সহিংস দৃশ্য থাকলেই যে তা মানুষকে সহমর্মিতাহীন সহিংস দানব করে তুলবে এমন ধারণা ভুল।

এমন দূর্ঘটনা গ্র্যান্ড থেফট অটোর নিয়মিত দৃশ্য

অন্যের শারীরিক যন্ত্রণা গেমারদের ভেতরে সহমর্মিতার অনুভূতি (empathy) গড়ে তোলে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করেছেন এই চীনা গবেষকরা। সে গবেষণার ফল হিসেবে এসেছে এই নতুন তথ্য।

ভিডিও গেমস আমাদের সহিংস করে তোলে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে চোখ ফেরানো যাক। সত্তরের দশকে ‘ডেথ রেস’ নামের এক রেসিং গেম আসে মার্কিন আর্কেডগুলোতে। এই গেমে গাড়ি চালাতে চালাতে গ্রেমলিন নামের ক্ষুদে দানবদের পিষে মারতে হতো, আর তাতেই জুটতো পয়েন্ট। যদিও ‘সহিংস’ এই গেম নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ। জনতা এতোটাই ক্ষেপে যায়, যে কিছু আর্কেডে চলে ভাঙচুর, আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয় কতকগুলোতে। কিন্তু ‘সহিংস’ গেমসের বিরুদ্ধে জোরশোর আন্দোলন শুরু হয় নব্বই দশকের শেষের দিকে। ১৯৯৯ সালে কলম্বাইন হাই স্কুলের দুই ছাত্র গুলি করে আরও অন্তত ১৫ জন ছাত্রকে হত্যা করে। আমেরিকা তো বটেই, গোটা বিশ্বেই আলোড়ন শুরু হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, ঘাতক দুই কিশোর ‘উলফস্টেইন থ্রিডি’ এবং ‘ডুম’ নামের দুই অস্ত্রভিত্তিক গেমসের ভক্ত ছিলো। ভিডিও গেমস শিল্পের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গেমস এবং সহিংসতার সূত্র সন্ধানে আমেরিকার জনগণ প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। ৫৩ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ আমেরিকানের মতে, এক ব্যক্তি সহিংস গেমস খেললে, সেটা তার আচরেণ প্রভাব ফেলবে।

মর্টাল কমব্যাটের গ্রাফিক ভায়োলেন্স নিয়েও কথা হয়েছে অনেক

চীনের গবেষকদের কাছে আবার ফেরা যাক। মোট ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী গেমার এই গবেষণায় অংশ নেন। সহিংস ভিডিও গেমস খেলেন কি না – এ প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে তাদের দুই দলে ভাগ করা হয়। এরপর তাদের হাতে মোট ৮০টি ছবি দেয়া হয়। কোনো কোনো ছবি ছিলো বেশ স্বাভাবিক, প্রতিদিনকার জীবনের টুকরো ছবি। আর কোনো কোনোটিতে ছিলো প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণার ছবি- অঙ্গচ্ছেদ, হাত-পায়ের কাটা অংশ ইত্যাদি ছবি। ছবি দেখার সময় অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তাদের এফ.এম.আর.আই বা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ইমেজিং করা হয়। আর তাতে দেখা যায়, শারীরিক যন্ত্রণার ছবিগুলো দুই দল নির্বিশেষে প্রায় সমান ধরণের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। গবেষণাপত্রের ভাষায়, ‘এই ফলাফল ইঙ্গিত করে যে, সহিংস ভিডিও গেমসের সঙ্গে সহিংসতাপ্রবণ হয়ে ওঠা কিংবা অন্যের যন্ত্রণার প্রতি অন্যভূতিশূণ্য হয়ে যাওয়া ইত্যাদির শক্ত কোনো সম্পর্ক নেই।’

কলাম্বাইন শ্যুটিংয়ে জড়িত দুই কিশোর ছিল উলফেনস্ট্যাইন গেমের ভক্ত

২০১৫ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ইস্যুতে করা গবেষণাগুলো পর্যবেক্ষণ কওরে এক প্রতিবেদন তৈরি করে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, সরাসরি সুনির্দিষ্ট প্রভাব না ফেললেও ব্যক্তি আচরণে সহিংসতা বাড়াতে প্রভাব রাখে ভিডিও গেমস। কিন্তু সেই প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মনোবিজ্ঞানী এবং অন্যান্য শাস্ত্রের পণ্ডিত প্রতিবাদ করেন। প্রশ্ন ওঠে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কার্যপ্রণালী বা মেথডোলজি নিয়েই। বিবিসিকে ইউনিভার্সিটি অব মিডলসেক্সের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ মার্ক কোলসন বলেন, ‘সহিংস ভিডিও গেমসগুলোর খুব বেশি হলে স্বল্পমেয়াদী প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। টানা তিন ঘণ্টা কল অব ডিউটি খেললে হয়ত বা ভেতরে ভেতরে একটু উদ্দীপ্ত বোধ করবেন আপনি, কিন্তু গেমস শেষে বন্দুক নিয়ে বের হয়ে ছিনতাই শুরু করে দিবেন, এমনটা ভাবা ভুল।’ গেমস খেললেই সন্তান সহিংস হয়ে উঠবে এমন ধারণা বাদ দিয়ে বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানীই বাচ্চার গেমস বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বরং রেটিংয়ের দিকে মন দেয়ার পরামর্শ দেন অভিভাবকদের।