সত্যজিৎ বাবু যেদিন রওনা করলেন অনন্ত শূণ্যের পথে সিনেমার নওল কিশোর ঋতুপর্ণ সেদিন এডিটিং প্যানেলে। ওর প্রথম ছবি হীরের আংটি নিয়ে। তোলা হয়ে গিয়েছিল আরও বেশ আগেই। মধ্যেখানে অর্থকড়ির টানাটানি। সময়মতো রিলিজ দেয়া গেলনা। এই যে প্রথম ছবিটা তাঁর জীবদ্দশায় বানিয়েও দ্রোণাচার্যকে (সত্যজিৎ রায়) একবার দেখাতে না পারার আক্ষেপ, একলব্য ঋতুপর্ণের রয়ে গিয়েছিল শেষাবধি। এরপর একে একে নানা ফর্মের ২১টি ছবি। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ীর পরে বাংলা সিনেমার নতুন কালপুরুষ।
জগৎসংসার ঋতুপর্ণ ঘোষকে ছবি করিয়ে হিসেবেই চিনবে; জানবে সিনেমায় তার নতুন ভাষা দেবার গল্প। এই সবর্বমান্যতার বাইরেও ঋতুপর্ণ আমাকে দিয়েছে এক অন্য রসের খোঁজ। যেখানে সে স্নিগ্ধ। মধুর। এখানে সে কেবলই গল্প বলে। জীবনের গল্প। আটপৌরে জীবন থেকে যে গল্পগুলো শুধু পা বাড়িয়ে বসে অমৃত আনন্দের পানে। সম্পাদক ঋতুপর্ণ ঘোষ। এর আগে জীবনে এক স্লিপও রিপোর্ট না লিখে, একটা ফিচারের Proof Copy না কেটেও সটান সম্পাদক। তাও কী- বাংলা ভাষার সব থেকে প্রভাবশালী প্রকাশনা গোষ্ঠীর সব থেকে প্রভাবশালী সিনে ম্যাগাজিন আনন্দলোক-এর সম্পাদক। অভিজ্ঞতা বলতে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান রেসপন্স-এ বছর দশেক কপি লেখা আর ঝোলায়, সাকুল্যে গুটি গুটি ভীরু পায়ে বানানো তিনটি ছবি। যদিও তার দুটি এরই মাঝে পেয়ে গেছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। এই সম্বলমাত্র পাথেয় করে ঋতুপর্ণ বাংলা কাগজ সম্পাদনায় তৈরি করলেন নতুন রাজপথ।
ঋতুপর্ণ যখন আনন্দলোকের ভার নিলেন তখন আনন্দবাজার গ্রুপ মানে সম্পাদকের মেলা। প্রবাদপ্রতিম সাগরময় ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী, দুলেন্দ্র ভৌমিক, অপর্ণা সেন এর সাথে বিভাগীয় সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাদল বসু, হর্ষ দত্ত, আবুল বাশার, জয় গোস্বামীরা তো রয়েছেনই। তার মাঝে মধ্য তিরিশের ঝকঝকে যুবক ঋতুপর্ণ যেন এক ‘হংস মধ্যে বক যথা’। তবু বাংলা কাগজ পেল এক নতুন সম্পাদকীয় ভাষ্য। আর তার নামটাও কী সিনেম্যাটিক, ‘টেক ওয়ান’। যদিও অপর্ণা সেন কিছু কাল আগেই বাকবদলের দিশা দিয়েছেন সম্পাদকীয়তে-তবু তা যেন পূর্ণতা পেল ঋতু’র হাতে। স্বাদু, মেট্রোসেক্সুয়াল গদ্য। তার সাথে পার্সোনাল টাচ। ফিচারগুলো রঙিন হলো এমন ব্লার্বে যা বাংলা কাগজ আগে কখনো দেখেনি। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের নেয়া সাক্ষাৎকার মানেই যেন বিস্ফোরন। সম্পূর্ণ নতুন কোন অ্যাঙ্গেল। তীক্ষ্ন, বুদ্ধিদীপ্ত, আনকাট। আনন্দলোককে একটানা সাত বছর টেনে কয়েক বছরের বিরতি।
কিন্তু কাগজ যে এক ভূতুড়ে নেশা। প্রায় নিশির ডাক। একবার যাকে পায় সে আর বেরোতে পারেনা। ২০০৬-এর ২৪ ডিসেম্বর ঋতুপর্ণ ফিরলেন তার পুরনো খেলাঘরে। ম্যাগাজিনই, তবে স্বতন্ত্র নয়। নবকলেবরে প্রকশিত দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন-এর সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘রোববার’ এর দায়িত্ব নিয়ে। শেষ লেখা ছাপা হল দোসরা জুন, ২০১৩। তার দুদিন আগেই ৩০ মে ঋতু মুছে দিলেন দৃশ্য-অদৃশ্যের ভেদ রেখা।
পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার, ছড়াকার, বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্র নির্মাতা, কপিরাইটার, আবৃত্তিশিল্পী, টেলিভিশন অ্যাংকর, অভিনেতা-এতসব পরিচয় ছাপিয়েও কেন বাংলা প্রকাশনার ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবেন ঋতুপর্ণ ঘোষ? এর উত্তর পাওয়া যাবে রোববারের প্রায় তিনশ সংখ্যায়। ভীষণ আটপৌরে প্রসঙ্গও যে কত অ্যাঙ্গেলে দেখা যায়, তার হাজারে হাজার নজির ছড়িয়ে আছে এই সব ‘রোববার’ এ। ব্রত, নাইট ডিউটি, লেডিজ হোস্টেল, গোরস্থান, আল্পনা, পরিযায়ী, সোনা, কবচ, কদম, মেঘ, কাবুলিওয়ালা, পদ্ম, পাটালি, টাইম টেবল এমনসব সামান্য বিষয় নিয়েও যে আস্ত একেকটা পত্রিকা বানানো যায়; আর দেখার গুণে, লেখার গুণে তা যে হয়ে উঠতে পারে আলো ঠিকড়ানো মনিকাঞ্চন, তা কে কবে ভেবেছে ঋতুপর্ণ ছাড়া?
আর এই সবগুলো সংখ্যায় প্রথম লেখাটাই ঋতু’র। শিরোনাম ‘ফার্স্ট পার্সন’। এই লেখাগুলোয় ঋতু’র বিশেষত্ব ছিল দুটো। এক, তার ইস্যুকে অ্যাড্রেস করার ক্ষমতা। দুই, মনিমুক্তোর মত গদ্য। যা কেবল কবিতার কাছে কাম্য ছিল একদিন। জয় গোস্বামী, শহীদুল জহির, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ হক-এই চারজন বাদে সমকালে আর কেউ এমন স্বাদুগদ্য লিখতে পারেন বা পারতেন বলে দেখিনি। অথচ এই চারজনই ফুলটাইম সাহিত্যিক। ঋতুপর্ণ এখানেও স্বতন্ত্র। শত কাজের ভিড়ে তার লেখা, সম্পাদনা। একি তার ১০ বছর বিজ্ঞাপনী অতীতের কারণে? শব্দ মেপে প্রিসাইজ কম্যুনিকেশনের যে বিজ্ঞাপনী অভিজ্ঞতা, তাই কি ঋতুকে দিয়েছিল অনন্য, অভিনব লোকপ্রিয় গদ্য?
ঋতু’র দখল ছিল মিথে, লোককথায়, প্রবাদ-প্রবচনে। চূড়ান্ত মড কোনো ইংরেজি কি ফরাসি শব্দের সঙ্গে সনাতনী বাংলা মিশিয়ে দিতে পারতেন অবলীলায়। আর দুইয়ে মিলে তৈরি হত দেদার ফুর্তি। আর ঐ যে বললাম ইস্যুকে অ্যাড্রেস করবার ক্ষমতা, সে তো ঝানু বার্তা সম্পাদককেও হার মানায়। সিগনেচার সম্পাদকীয়র মূল জাদু ছিল শেষ লাইনে। একদম ওস্তাদের মার শেষ রাতের মতো নিয়ম মেনে। একটা সাধারণ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্মৃতি রোমন্থনের ঘটনাও শেষ এক কি দুই লাইনের অভিঘাতে হয়ে উঠত সমকালীন কোন রাজনৈতিক বা বৈশ্বিক সংকট ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত। একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
“বড় মধুর, বড় চমৎকার একটা বাংলা শব্দ ছিল আমাদের অভিধানে- ঝি। মানে মেয়ে। অন্দরমহলের পুরুষতন্ত্র সেই এক মাথা চুল, বড় বড় চোখের শব্দটার হাতে কবে যেন ন্যাতা বালতি ধরিয়ে দিয়েছে। খুব বেশিদিন লাগবেনা। আগামী যুগের বাংলা অভিধানে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো উন্নয়নের মানে লেখা হবে ‘উৎখাত’। (এটা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা)
প্রচুর অপ্রচলিত, অব্যবহৃত বাংলা শব্দ আকছার ব্যবহার করতেন ঋতু অথচ তার প্রয়োগ করতেন চূড়ান্ত নাগরিক গড়নে। যেমন- ঋতুপর্ণ লিখছে। “হ্যা, আমি ‘প্রিটি প্রিটি’ ছবি করি। আমার প্রতিটি চরিত্র সুবেশ। প্রতিটি কক্ষ সুরম্য। প্রতিটি দৃশ্য মনোহর।”
এই যে তৎসম, তদ্ভব, অপ্রচলিত শব্দেরই স্লিম, হ্যান্ডসাম ব্যবহার এ কবে ছিল ঋতুপর্ণের আগে? কি যে অদ্ভুত তার দেখার চোখ আর বিশ্লেষণের অভাবনীয় কারুকীর্তি। বর্ণাঢ্য অভিজাত ভাষা ব্যবহারে সাবেকি গ্র্যান্ড পিয়ানোর মাধুর্য, তার সাথে চকিতে উকি দেয় মৃদঙ্গের মেখলা, আড়বাঁশির হিয়া ওপড়ানো টান। আর লেখার শেষে টান টান চিত্রনাট্যের অনিবার্য মোচড়। অথচ এই সাপ্তাহিক কলমকারিতে ক্রমাগত ঋতুপর্ণ অনুশীলন করে গেছেন নম্রতার, সহাবস্থানের। অন্বেষণ করেছেন মাধুর্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন রুচির দারিদ্র নিয়ে যে হাহাকার করে গেছেন মৃত্যু অবধি ঋতুপর্ণ যেন সেই রুচিশিক্ষারই প্রাণবল্লভ। বিষ্মিত, বিপন্ন, প্রতিবাদী, আনন্দিত, বাউন্ডুলে, গৃহস্থ সর্বোপরি নিজের শর্তে বাঁচা সৎ ও আন্তরিক ঋতুপর্ণের ব্যক্তিগত অনুভবই তার সম্পদকীয় সাহিত্য ‘ফার্স্ট পার্সন’।
সময়টা ২০০২ এর শেষ কি ০৩-এর প্রথম ভাগ। আমি তখন গোগ্রাসে গিলছি আনন্দলোকের সম্পাদকীয়। দুবার চারবার করে দেখে ফেলেছি ঋতুপর্ণর একেকটা ছবি। আর মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে সত্যজিৎ পরবর্তী বাংলা সিনেমার নতুন ‘মসিহা’ ইমেজ। কিন্তু ‘এবং ঋতুপর্ণ”তে ঋতু’র আপাত ন্যাকা (বলা ভাল আদুরে টেলিপ্রেজেন্স) কিংবা পত্রপত্রিকায় মেয়েলি (তথাকথিত) পোষাকের পোজ আমার মধ্যে তৈরি করে নিদারুণ অস্বস্তি। আজন্ম লালিত শরীরী সংস্কার তৈরি করে দ্বিধা। ভাবখানা এমন, চান্স পেলেই ঋতু যে কোন ব্যাটাছেলের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। সত্যজিৎকে মাথায় রেখে তৈরি হওয়া যে ফিল্ম ডিরেক্টরের ম্যাসকুলিন ইমেজ তার করুন ডেস্ট্রাকশন আমাকে আর্ত করে তোলে। এমন এক সময়ে তৈরি হয় এক ছোট্ট সম্ভাবনা। সম্পাদক নয় ডিরেক্টর ঋতুপর্ণের ইউনিটে সামান্য কাজ করার। মফস্বলী ঘেরাটোপে বন্দি আমার দ্বিধাময় মনন আর প্রথাবদ্ধ সেক্সুয়াল পারসেপশন আমাকে অজানা শংকায় আচ্ছন্ন করে। আমি ভয় পাই। আজ এত বছর পরে নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেকেই গাল দেই। রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যজিৎ তো আমার টাইম ফ্রেমের নন কিন্তু আমার জীবৎকালীন শ্রেষ্ঠতম কীর্তিমান মানুষের সাথে সুযোগ পেয়েও কাজ না করতে পারার আক্ষেপ এ জীবনে আর যাবে না।
ছবি: সংগৃহীত