বাংলা ইসলামী গান ও নজরুল-কে কার পরিপূরক?
বঙ্গে সুফি প্রভাবের মতোই বাংলায় ইসলামী গানের শুরুটা কখন? এ প্রশ্নের শতেক উত্তর আছে। কিন্তু প্রথম প্রশ্নের উত্তর একটাই। আর সেটা হল উভয়েই। কেননা কাজী নজরুল ইসলাম না আসলে বাংলায় ইসলামী গানের চর্চাই শুরু হয় না। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তরে বলা যায়, বাংলায় প্রথম গানের তা সে ইসলামী কিংবা কীর্তন যাই হোক না কেন-তার লিখিত ইতিহাস পাওয়া বড্ড মুশকিল। তবে বাংলা ইসলামী গান রেকর্ড আকারে প্রথম কখন প্রকাশিত হয় সেটির সংবাদ পাওয়া যায়।
এবং সে সংবাদও পাওয়া যায় স্বয়ং শিল্পীর জবানিতেই। আগ্রহী শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমেদকে বুদ্ধি দিয়ে, নিজে গান লিখে-সুর করে কাজী নজরুল ইসলাম ঘটিয়েছিলেন সেই বিষ্ময়কর ঘটনা। যার সাথে জড়িয়ে আছে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানির বড়কর্তার অনুমতি পাওয়ার আধঘন্টার ভিতরেই বিদ্রোহী কবির ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ লেখার গল্পও। আর সেই প্রথম রেকর্ডকৃত ইসলামী গানটি আজও আমাদের ঈদ-উল- ফিতরের উৎসবের অন্যতম উপসর্গ।
প্রথম গানটি লেখার পরের দিনই নজরুল লিখেছিলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। এইচএমভির রেকর্ড নং এন ৪১১১-এর এক পাশে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ এবং অপর পাশে ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’ গান দুটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের রমজান মাসে। এবং তারই সাথে সংগীতে বিমুখ বাঙালি মুসলমান সমাজ যেন আনন্দে নেচে উঠলো, হেসে উঠলো, গেয়ে উঠলো ইসলামী গান। এত দিন যেন এই গানেরই অপেক্ষায় ছিল তারা।
পাপ! বলে নিজেদের জীবনে যারা গানের-সুরের প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তারাও নজরুলের কথা-সুর আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠের জাদুতে আগল খুললেন বদ্ধ দুয়ারের। দারুণ শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়ায় নতুন নতুন ইসলামী গান লিখতে শুরু করলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও। ১৯৩২ থেকে ১৯৪২, মাত্র ১০ বছরে তিনি বাঙালি মুসলমানকে সংগীতপ্রেমী করে তুললেন। বাঙালির ইসলামী গানের ভান্ডার আজও পূর্ণ হয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের গানে।
রীতিমত দরখাস্ত করে শ্যামাসঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত মুসলিম শিল্পী কে. মল্লিকও গাইতে শুরু করলেন ইসলামী গান। গাইলেন তকরীম আহমদ, আবদুল লতিফ। গ্রামোফোন কোম্পানির বুদ্ধিতে ইসলামী গান গাইতে ধীরেন দাস হলেন গণি মিঞা, চিত্ত রায় হলেন দেলোয়ার হোসেন আর গিরীশ চক্রবর্তী নাম বদলালেন সোনা মিঞায়।
এমনকি বাংলায় ইসলামী গানের রেকর্ড বের হওয়ার আগে যেসব উর্দু কাওয়ালের গান মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল তারাও নজরুলের বাংলা গান গাইলেন।
গানের পাশাপাশি ঈদ, কোরবানি, মহররম, মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন নিয়েও প্রচুর কবিতা লিখেছেন নজরুল। তাঁর লেখা থেকে বাদ পড়েননি এমনকি বিশিষ্ট সাহাবী ও ইসলামী আন্দোলনের অন্য যোদ্ধারাও।
প্রচুর ইসলামী গান রচনার আগেই বিদ্রোহের কবিতায়, শ্যামাসঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলাম তুমুল জনপ্রিয়। ‘আকাশ বাণী কলকাতা’-এর প্রচারিত সব সম্প্রদায়ের উৎসবেই তিনি গীতি আলেখ্য রচনা করেছেন । অবশ্য ১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই বেতারে শিশুদের আসরে ১০ মিনিটের একটি কথিকা প্রচারের সময় হঠাৎই অসুস্থতায় বাকরুদ্ধ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। থেমে যায় নজরুলের কলম।
উন্মত্ত হাসিতে যে কবি কাঁপিয়ে তুলতেন বাতাস সেই কবি থেমে গেলেন চিরতরে। থেমে গিয়েছেন, বিদায় নিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু যে সৃষ্টি তিনি রেখে গিয়েছেন, তা বাঙালির কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকবে যুগ যুগান্তর, শতাব্দীর পর শতাব্দী।
শুভ জন্মদিন প্রিয় বিদ্রোহী কবি।
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে- সোহরাব হাসান
মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে- ফেরদৌসী রহমান
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই- ফিরোজা বেগম
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে- সতীনাথ মুখোপাধ্যায়
যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার- ফিরোজা বেগম
নাম মোহাম্মদ বোল রে, নাম আহম্মদ বোল- – ফিরোজা বেগম
নামাজী তোর নামাজ হলো ভুল- নাশিদ কামাল
আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান- আব্বাস উদ্দীন আহমেদ
রোজ হাশরে আল্লাহ আমার কোরো না বিচার- আব্বাস উদ্দীন আহমেদ
ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর-নাশিদ কামাল