বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই মুসলিম। আর সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগই নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে বাঙালি, আর সঙ্গতভাবেই তাদের ভাষা বাংলা। অন্যদিকে তাদের অবিচল আস্থা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানে, যা আরবিতে পঠিত হয়। ভাষা হিসেবে আরবি সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান না থাকলেও বাঙালি মুসলমান গোষ্ঠীর কোরানের ওপর দক্ষতা সীমিত নয়। কারণ তারা আরবিতে নিজে থেকে একটি বাক্য লিখতে না পারলেও অক্ষরজ্ঞানসর্বস্ব দক্ষতার জোরেই ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানেরা তাদের হাজার বছরের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়ের অপেক্ষা নিজেদের ধর্মভিত্তিক সামাজিক পরিচয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুসলমানদের জীবনাচরণে ভাষাদর্শনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি প্রামাণ্য রূপ পায়।
শিশুর জন্মের পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের নামকরনের জন্য সবচেয়ে ভালো এবং খুব সুন্দর অর্থের অনন্য কোন শব্দ খোঁজেন। আশির দশক থেকে শুরু করে এমনকি শূন্য দশকেও শিশুর নামকরনের ক্ষেত্রে মুসলিম বাবা-মায়ের কাছে ডাকনাম হিসেবে অতি আবশ্যকীয় ছিল একটি বাংলা নাম, যদিও ভালো নাম মানে কেতাবি নামটি আরবি-ফারসিতেই রাখার চল ছিল। অথচ চলতি দশকে অদ্ভুতভাবে সন্তানের ডাকনামের জন্যও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নুয়াইরা, আমিরাহ্, নুসাইবা, আরিয়া, আনায়া-র মতো আরবি কিংবা আরবির মতো শোনায় এমন সব শব্দ। তবে কি বাংলা ভাষায় সুন্দর অর্থ বিশিষ্ট অনন্য কোনো শব্দ আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
এতো গেলো শিশুর নামকরনের প্রসঙ্গ। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদের আমলে ‘মুসলমানি বাংলা’ এবং আরবি হরফে বাংলা লেখা চালু করার চেষ্টা আজ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ইতিহাসের অংশ। যদিও শুধু শিশুর নামকরন নয়, গেল কয়েক দশকে অতি দ্রুততার সাথে সম্ভাষণ জ্ঞাপন এবং ইসলামি আচার পালন সংক্রান্ত পরিভাষাগুলোও বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিদায় সম্ভাষণের রীতিটিও এখন বদলে গেছে শতভাগ। গেল শতকের গোড়ার দিকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে পরস্পরকে সম্ভাষণের ক্ষেত্রে ‘আদাব’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। উদাহরণের জন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গল্প উপন্যাস খুঁজলেই চলবে। নব্বইয়ের দশকেও পল্লী-মফস্বলে এ ধারাটি বজায় ছিল। কিন্তু এরপরে দ্রুতই বদলে গেছে চারপাশ। এখন মুসলিম ছাত্ররা যেমন হিন্দু শিক্ষকদের সালাম জানিয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে, তেমনি হিন্দু ছাত্ররাও মুসলিম শিক্ষকদেরকে ‘আদাব’ নয়, ‘সালাম’ দিচ্ছে। এতো এক প্রকার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা-শাসনই বটে!
আশির দশকের গোড়ার দিকে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় বাংলা নামের দেশে এক বিশেষায়িত জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। সাথে যুক্ত হয় পেট্রোডলারের বেগবান রসদ এবং অতি আবশ্যক ভাবে ওয়াজ। ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রচারের এই রীতি বেগ পায় সামরিক স্বৈরশাসনের বুটের প্রলম্বিত ছায়ায়। পরবর্তী দশকের শেষে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের শেষের সময়ে এ অঞ্চলে ওয়াহাবি মতাদর্শের প্রধান উদগাতা জামায়াতে ইসলামের পরিকল্পিত ও সক্রিয় প্রয়াসে এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সামান্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যোগ করা যাক। কোন এক ঈদের ছুটি শেষে মফস্বল থেকে বিদায়ের সময় আমার পরিবারেই বিদায় সম্ভাষণ হিসেবে প্রথম শুনেছি ‘খোদা হাফেজ’-এর বদলে ‘আল্লাহ হাফেজ’। শহুরে আত্মজনেরা ‘খোদা’ শব্দটির বদলে ব্যবহার করেছিলেন ‘আল্লাহ’। তখন খুব খটকা লাগলেও এখন আর লাগে না, এখন এটাই রীতি। নিজের বাড়িতে যেমন, তেমনি কর্মস্থলে চলতে ফিরতে শিক্ষার্থীদের টুকরো কথায় এই রীতিই প্রবল।
ঘটেছে কিছু ঘটনা সম্বোধন নিয়েও। সম্বোধন সূচক ‘দাদা’ শব্দের পরিবর্তে ‘ভাই’ শব্দটির প্রচলনও আশির দশকের গোড়ার দিকেই শুরু হয়। যদিও ‘ভাই’ শব্দটি সংস্কৃত ‘ভ্রাতা’ উৎসজাত আর ‘দাদা’ ফারসি অথবা তুর্কি উৎসজাত। এক্ষেত্রে ‘হিন্দুয়ানি’ ভাষা সংস্কৃত থেকে জাত ‘ভাই’ শব্দটির এক ধরনের মুসলমানিকরন ঘটল। সম্ভাষণের এই বিশেষ রীতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, বাহন ভাষাতাত্ত্বিক আর পদ্ধতিটি ছিল অবধারিতভাবেই ধর্মীয়। ‘খোদা’ শব্দটি ফারসি এবং আর ‘আল্লাহ’ শব্দটি আরবি। যদিও এদেশের মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের ব্যাখ্যা যে একটি ফারসি এবং একটি আরবি শব্দ এক সাথে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থেকে জাত একাধিক শব্দ বাংলা ভাষায় একটি শব্দগুচ্ছ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমলনামা, কবিরা গুনাহ কিংবা হারামজাদা -এর কথা। তারা এতকিছু বোঝেন কিন্তু এটা বোঝেন না যে, আরবি এবং ফারসি দুটো ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী থেকে জাত। প্রথমটি সেমেটিক পরিবারের ভাষা আর দ্বিতীয়টি ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষা। আর তাই এ দু’টি ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক সংযোগ খুব সহজ কিংবা সহজাত নয়। কিন্তু ইসলাম প্রচারের সূত্রে ফারসি ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ আহরিত হয়েছে এবং আরবি ভাষাতেও অনুল্লেখযোগ্য পরিমাণের হলেও ফারসি উপাদান রয়েছে। আর বঙ্গে সুফি প্রভাবের কারণেই দু’টি ভিন্ন ভাষার শব্দ একত্রে গৃহীত হয়েছে। বস্তুত সুন্নি আরব ও শিয়া ইরান উভয়ের ভাষাই প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূরের বঙ্গদেশের ভাষাকে প্রভাবিত করেছে।
অবশ্য আরবিকরনের প্রক্রিয়ায় হীনস্মন্যতায় ভোগা বাংলাভাষীদের মনে খুব সযত্নে গত কয়েক দশক ধরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আরবি শব্দই খাঁটি ইসলামের প্রতিভূ, অন্যদিকে ইসলামি ধর্মীয় আচার পালনে ফারসি শব্দের ব্যবহার সহীহ্ নয়। অথচ ইতিহাস বলে তুর্কি আগ্রাসনের পূর্বেই বঙ্গে ইসলাম প্রচারের সূত্রপাত ঘটে সুফি সাধকদের মাধ্যমে, এবং তাদের সুবাদেই প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিদেশী ভাষা থেকে আহৃত এ জাতীয় শব্দকে বলে ‘কৃতঋণ শব্দ’। এই কৃতঋণ শব্দগুলো যেকোনো ভাষায় আত্মীকৃত হওয়ার সময় লক্ষ্য ভাষাটির ধ্বনিতত্ত্বের অনুগামী হয়েই ভাষাটিতে নিজের জায়গা করে নেয়। আর তাই এ শব্দগুলোকে আর বিদেশী ভাষার শব্দ বলে অভিহিত করা যায় না। যেমন, ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় আত্মীকৃত টেবিল, ইস্কুল, জজ ইত্যাদি শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডা্রের সম্পদ, কারণ এই ইংরেজি শব্দগুলোর প্রকৃত উচ্চারণ প্রায় এমন- টেবল, স্কুল, জাজ। বিকৃত কিংবা অবিকৃত কিংবা ঋণকৃত ইংরেজি শব্দের ব্যবহার অবশ্য খাঁটি ইসলাম চর্চায় কোনো বাধ সাধে না। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের খাঁটি ইসলাম চর্চা এবং সহীহ্ মুসলিম হওয়ার পথে যেন একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় আচার সংক্রান্ত ফারসি উৎসজাত শব্দগুলো।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ভাষায় ‘রামাদান’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করছে ‘রমজান’ শব্দটিকে। ফারসি উৎসজাত ‘রমজান’ শব্দটি বাংলা শব্দভাণ্ডারে আত্মীকৃত হওয়ার সময় বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক অনুশাসন প্রযুক্ত হয়েছে। যারা খাঁটি মুসলিম হওয়ার অভিপ্রায়ে ‘রমজান’ শব্দটির বদলে ‘রামাদান’ ব্যবহার করছেন তারা নিঃসন্দেহেই দুশ্চিন্তায় পড়বেন যে ‘রামাদান’ ব্যবহার করলেই সেটি খাঁটি ইসলাম চর্চার প্রতিভূ হচ্ছে না। বরং ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ‘রামাদান’ শব্দটির সহীহ্ আরবি উচ্চারণ একজন নৃতাত্ত্বিক বাঙালির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ বাংলা ও আরবি ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চারিত্র্য বহু যোজন দূরের!
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক টুইটে আসন্ন রমজান উপলক্ষে ভারতীয় মুসলিমদের যে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সেখানেও তিনি ‘রামাদান’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। হয়ত তিনি শব্দটির ইংরেজি প্রতিবর্ণীকরনকেই অনুসরণ করেছেন। কিংবা তথাকথিত সহীহ্ ইসলামধারীদের আকৃষ্ট করতে তিনি একটি আভিধানিক ‘হাই ফ্যাশন’ হিসেবেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যদিও প্রত্যুত্তরে একজন ভারতীয় মুসলিম টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন যে শব্দটি ‘রমজান’ হওয়া উচিত।
এ থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে, মুসলমানের ভাষাতাত্ত্বিক হীনস্মন্যতা কেবল বাঙালি নয়, বরং ভারতের অন্য ভাষাভাষী মুসলিম এবং পাকিস্তানি মুসলিমদের মধ্যেও লক্ষণীয়। এমনকি ইদানিং যে কিছু উর্দুভাষী পাকিস্তানি মুসলিম ‘পাকিস্তান’ শব্দটি উচ্চারণ করছেন ‘বাকিস্তান’ বলে। কারণ, আরবি ভাষায় ‘প’ ধ্বনিটির অস্তিত্ব নেই, কিন্তু ‘ব’ আছে। আর তাই খাঁটি মুসলিম হওয়ার বাসনায় তারা তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়গত নামটিকেও আনন্দের সঙ্গেই আরবিকরন করে নিচ্ছেন। সুতরাং এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে মুসলমানদের কাছে তাদের ধর্মীয় পরিচয়টিই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ আর তাই তাদের ভাষা-মানস নিয়ন্ত্রিত হয় খাঁটি মুসলিম হয়ে ওঠার অভিপ্রায় দ্বারা। তবে বাঙালিরা, বাংলাদেশের মানুষেরা হয়ত একটি বিষয়ে এ যাত্রা বেঁচে গেলো। কারণ সৌভাগ্যবশতঃ ‘ব’ ধ্বনিটি আছে বাংলা ও আরবি উভয় ভাষাতেই, তাই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির আরবিকরনের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই!