চেরাগ ঘষতেই দৈত্য বেরুলো। নিপাট ভদ্রলোক। ডিফল্ট সেটিংয়ে থাকা প্রশ্ন করে দায় সারলো না। সে জানে অপশন আমাদের কত্ত পছন্দ! তাই দিলো মাল্টিপল চয়েজ। এর মধ্যে একটা তো দারুণ লোভনীয়— “বলো মিনা, তুমি কি শিনেমার নায়িকা হতে চাও?” ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন বাজছে দিলওয়ালে দুলহানিয়ার মিউজিক। তাতে কী! ক্রেডিট কার্ডের হিডেন চার্জতুল্য ওসব অফারের ফাঁদে পা দিতে মিনা’র বয়েই গেছে। আমাদের মিনা চরম কিউট। পাশাপাশি সেন্সিবল। তাইতো সে চাইলো সবার জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। অত্যন্ত কল্যাণমুখী চাওয়া। চাওয়ার পেছনে যদি কোনো ভালো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে ‘চাওয়া’ও ভালো। তারপরও নাকি বিশেষ সূত্রে জানা যায়, মিনা’র এই ‘শিনেমা’র লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার সিদ্ধান্তে তখনকার অগণিত কিশোরীর কোমল মনে সরল প্রশ্ন- “এ কী করলেন মিনা”! ভিডিও-সহ দেখেও অজান্তে আফসোসের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর শ্বাসই পড়লো কেবল। মিনা, এ কেমন বিচার!
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। সেদিনকার কিশোরীকূলের অনেকেই আজ নতুন ‘কুল’ জেনারেশনের জননী। তাদের অন্তরে আজো নানান আফসোসের বসতবাড়ি। ওসব আফসোস আরো উস্কে দিতে এর মধ্যে দেশের আলো-বাতাসে এদিকে সেদিকে ঢুকে এঁকেবেঁকে ভালোই জেঁকে বসেছে ইন্টারনেট। সে-ও এক আজব চেরাগের দৈত্য। যা চাই, তা-ই হাজির করে চোখের সামনে। হ্যাঁ, হয়তো আক্ষরিক অর্থে বস্তুটাকে সবসময় হাজির করে না। তবে গুগোল-এর জ্ঞানের রাজ্যের সন্ধান যে একবার পেয়েছে, সে-ই জেনেছে— বাদশাহ আকবরের দরবারে কেউ কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরলেও ফিরতে পারে, গুগোল কখনও কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। মরুরাজ্যে পানির সন্ধানলাভ কিংবা যেভাবে বানাতে হয় স্পেস শাটল; ইন্টারনেটের ভান্ডারে মামা, বিবিধ রতন। অনেক দেশে অনেক স্বৈরাচারী সুপারপাওয়ারও পাওয়ার অব ইন্টারনেটের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে। ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে কতো দেশের লিটারেসি রেট আর লিভিং স্ট্যান্ডার্ড উপরে উঠে গেলো তার হিসেব নেই। তো এই ইন্টারনেট, আদর করে যাকে অনেকে বলি ‘অন্তর্জাল’, তার কাছে আমাদেরও অনেক কিছু চাওয়ার আছে। আমরা তা চাই-ও। আর সেগুলো বে-শ গুরুত্বপূর্ণ। এই যেমন ধরুন ‘চিকন পিনের চার্জার’। কমিউনিকেশনের উত্তাল এই সময়ে জাতীয় জীবনে মোবাইল ফোনের নিরবিচ্ছিন্ন সেবার ভূমিকা অপরিসীম। তাই যথারীতি অনস্বীকার্য চিকন পিনের চার্জারের গুরুত্ব। উক্ত চার্জারের ব্যবহারকারী মাত্রই জানেন প্রয়োজনীয় সময়ে চার্জার না পেলে কতোটা নাজেহাল হতে হয়। বিজনেস ডিল থেকে মাত্র গড়ে উঠি উঠি সম্পর্ক, যেকোনোটাই ভেস্তে যেতে পারে চার্জের সংকটে। অতএব, চিকন পিনের চার্জারের দাবি অত্যন্ত যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত। প্রমাণিত। আর কিউট বাঙালি কোনোকিছু চাইলে তার শেষ দেখে তবেই ছাড়ে। চিকন পিনের চার্জারের সন্ধানলাভের যৌক্তিক দাবি থেকে তাই রেহাই পাননি শাহরুখ খান, সাকিবকন্যা অ্যালাইনা থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, হিরো আলম কেউই।
ওদিকে নামের মধ্যে ভাই থাকলেও ভাইরাল কন্টেন্টের স্থায়িত্বের মা-বাপ নেই। উনি খুবই ট্রেন্ডি। প্রতিনিয়ত তার মেতে থাকার জন্য পাতে নতুন কিছু চাই। সেই রীতি মেনে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় (নিঃসংকোচে ফেসবুক পড়তে পারেন) কিউট বাঙালির চাওয়াটা আরো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিকে ঘিরে। জ্বী ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত অ্যাকটিভ’ পাঠক, ঠিক ধরেছেন। দাবিটা আপনার, আমার, সকলের। প্রতিদিন একবার হোম পেইজ স্ক্রল করলে কোনো এক কোনায় ঠিকই ঘাপটি মেরে থাকতে দেখা যায় ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’-এর জ্বলজ্বলে দাবি। গত কয়েক মাস ধরে ক্রিকেট মাঠ থেকে নদীর ঘাট, র্যান্ডম পোস্টে, স্ট্যাটাসে, ছবিতে, এই দাবিতে সোচ্চার ফেসবুকারের সরব কমেন্ট পাওয়াই যাচ্ছে অহরহ। আর তাতে যা হয়। সরস বাঙালির সরেস ট্রল থেকে নিস্তার পায়নি গণমানুষের(!)এই দাবি। নোয়াখালীতে জন্ম নেয়া কিংবা বসবাসরত এবং নোয়াখালীর গুণমুগ্ধ সকলের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে এইসব ট্রল নিয়ে আমাদের এক বালতি জলাঞ্জলি।
১. প্রকৃত সেলিব্রেটি তো তিনিই, যিনি ভক্তদের মনের কথাটি জানেন। জানেন তাদের দাবির সাথে একাত্ম হওয়া কতোটা গুরুত্বাবহ। এই কিউট ফুটবলারটির জন্য কয়টি লাইক হবে, আর্জেন্টিনা?
২. এই গুরুতর অপরাধের জন্য কাটাপ্পার তিন মাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসির আদেশ।
৩. এর সাথে অন্য অঞ্চলটিকে কেনো জড়ানো হলো বোধগম্য হলো না। যাইহোক, পাসপোর্ট করানোর আগে দালাল হইতে সাবধান।
৪. এটাও বুঝলাম না। এতোদিনে তো কয়েক লক্ষ বার বিভাগ হয়ে যাবার কথা!
৫. কে বলে দেশের শিক্ষার্থীরা গণিতে আগ্রহী নয়? এইতো কী সুন্দর অংক কষে প্রমাণ করেছে দাবির যৌক্তিকতা। চাচা, নাসা কতোদূর?
৬. এই অনিবার্য দাবির সাথে রয়েছে আধ্যাত্মিকতারও যোগসূত্র। ভুলে যাবেন না, সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ‘৭’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা।
৭. ছাপার অক্ষরে এমনটা দেখার আর বেশিদিন বাকি নেই।
৮. এই প্রচণ্ড দাবদাহে রেফ্রিজারেটর খুলেই যদি পাওয়া যায় এমন প্রশান্তির বার্তা… দেহ-মন চাঙা হতে আর কি চাই বলুন?
৯. মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
১০. লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, কালজয়ী এক ফ্রেমে তিন কিংবদন্তি। তবে দাবি কিন্তু একটাই।
* পুরো বিষয়টাই স্যাটায়ার। কেউ কোনো ধরনের অনুভূতিতে আঘাত পেলে লেখক দায়ী নন।
ছবিঃ ফেসবুক থেকে সংগৃহীত