প্রসঙ্গ ঋতুপর্ণঃ শিরোনামের খেরোখাতা

“খেলা খেলা দিয়ে শুরু

খেলতে খেলতে শেষ

কেউ বলেছিল ছিঃ ছিঃ

কেউ বলেছিল বেশ।

কেউ বেসেছিল ভাল

কেউ খুঁজেছিল আলো।

কেউ আলো খুঁজে পায়নি বলেই

হয়ত নিরুদ্দেশ।।”

তবে জীবন দেখে আর ঘেঁটে আজ বলতে পারি, আলো খোঁজা মুখগুলো কখনও নিরুদ্দেশ হয়না। বরং সীমান্তে আলোর দিশায় পথ দেখায়। সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী চলচ্চিত্র মহাশুন্যতায় বাংলা চলচ্চিত্রে তেমনি এক মুখ ঋতুপর্ণ ঘোষ। নবতরঙ্গের ঋতুকে খুব আপন আটপৌরে নিজের মানুষ মনে হয়। কারণ কি? বাস্তব থেকে দূরে সরানো চটকদার ছায়াছবির প্রহেলিকা থেকে, এই মানুষটা আমাদের এক ধাক্কায় আবার সেই মধ্যবিত্ত জীবন, নারীর অবস্থান কিংবা সামাজিক যৌন অবদমনের জায়গাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বলে? ঠিক যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে হতাশ ক্ষুধার্ত বাঙালি escape route হিসেবে মধ্যবিত্ত চেহারার কিন্তু দারুণ smart এক মহানায়কের চেহারায় উত্তমকুমারকে বেছে নিয়েছিল?

১২টি জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন ঋতুপর্ণ

এ লেখাটা ঋতুর ছবিতে সঙ্গীত নিয়ে। আচ্ছা, আমরা কি বড় হয়ে যাচ্ছি? নাহলে স্কুলের সামনের বাদাম, আলুকাবলি বা শোনপাপড়ির মতই বুঁদ হয়ে থাকা কৈশোরের ঋতুকে নিয়ে লিখতে বসেছি কেন? দোষ তোমার ঋতু। এত সকালে তোমার চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি একদম।

শুরুটা তো করি। জানি এ লেখা অনেকদুর গড়াবে। তাইতো এর উপনাম “শিরোনামের খেরোখাতা”।

শিরোনাম বা Title ব্যবহৃত হয় সব চলচ্চিত্রেই। সেখানে সব কুশীলবদের নাম দেখানো হয়। দর্শক হিসেবে একথা আমরা প্রায় সবাই স্বীকার করে নেব যে, ওইটুকু দেখা হয়না কারোই মন দিয়ে। দেখেন শুধু তারাই যাদের স্বজন বা বন্ধুদের নাম ওই তালিকায় আছে কিংবা শ্যেনচক্ষু চলচ্চিত্র সমালোচকগণ। আজকালতো সে সংখ্যাও কমেছে আরও কারণ সিনেমা হলে যেয়ে ছবি দেখার অভ্যেসতো আমাদের চলেই গেছে। বিভিন্ন পুরস্কারের জন্যেও বিচারক মহোদয়দের কাছে এখন DVD পাঠাতে হয়। কারণ তাঁরাও এখন হলে বসে ছবি দেখার সময় পাননা।

কিন্তু সেই শিরোনামকে দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন ঋতু। একদম শুরু ৯২ তে সরকারি অনুদানে বানানো সেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র “হীরের আংটি”, যেটি সিনেমা হলে মুক্তি পর্যন্ত পায়নি, সেটির কুশীলবদের নাম দেখানোর সময় আবহে ছিল সেই মহিষাসুরমর্দিনী, সেই মহালয়ার অমোঘ কণ্ঠস্বর। কেন? কারণ ঘটনা দুর্গাপুজার সময়কে কেন্দ্র করেই। শব্দ এবং সঙ্গীত চলচ্চিত্রে স্থান,কাল ও পাত্রকে ত্রিমাত্রিকভাবে উপস্থাপিত করতে পারে। ঋতু সেটি করলেন। ঠিক এই আবহই সাথে ঢাকের বাদ্যিতে তাঁর “অন্তরমহলে”ও আমরা পেয়েছি। সেখানে চরিত্রের মানসিক অবস্থান বোঝানোতে যা অনিবার্য ছিল। আর ততদিনে দেবজ্যোতি মিশ্রের মত দুর্দান্ত সঙ্গীত পরিচালক ঋতুর ধুপে ধোঁয়া দিচ্ছেন। এক রামে রক্ষা নেই তায় সুগ্রীব দোসর! এরপর আরো খানিক পরেতো সকল ঋতুরাগ দেবজ্যোতির মহিমায় প্রকাশিত হতে লাগলো।

ঋতুর দ্বিতীয় কিংবা মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবিতে আসা যাক। নাম “১৯শে এপ্রিল”। ১৯৯৪ এ বের হল। হ্যাঁ, শুরুতেই ছক্কা। জাতীয় পুরস্কার। এটার সঙ্গীত পরিচালক জ্যোতিস্ক দাশগুপ্ত। শিরোনামে আসি আবার। মরা বাড়ি। মৃতদেহ শোয়ানো। আগতদের গুঞ্জন। কিন্তু রান্নাঘরে চা বানানোর বিরাম নেই। আমরা কুশীলবদের নাম দেখছি চা বানানোর টুংটাং আওয়াজের সাথে। মাঝে মাঝে ফোনের আওয়াজ। বাড়ির বাচ্চাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার আওয়াজ। রাত হয়েছে বলে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। আর শিরোনামের শেষ দিকে ভরতনাট্যমের Dance Classical এর রেশ। কেন মৃদঙ্গ আশ্রিত তালে এই কর্ণাটকি নৃত্য সঙ্গীত? কারণ, প্রয়াত ব্যক্তির স্ত্রীর ভূমিকা চরিত্রটি (অভিনয়ে অপর্ণা সেন) একজন স্বনামধন্য ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী এবং তখন তিনি তাঁর performance এর কারণে মাদ্রাজ অবস্থান করছিলেন। আবারও ঋতুপর্ণ সঙ্গীতে আর শব্দে স্থান কাল পাত্রের এক দারুণ অবতারণা করে দিলেন।

চলচ্চিত্রের সারসংক্ষেপ বা synopsis এবং মুক্তির আগে Trailer বলে দুটো বিষয় থাকে। যা থেকে দর্শক ছবিটি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা এবং আগ্রহ পায় ।ঋতুপর্ণ ঘোষ শব্দ এবং সঙ্গীত দিয়ে এই জায়গাটাকে সৃষ্টিশীল এক নব চূড়ায় নিয়ে গেলেন। অবশ্যি এমন নয় যে তাঁর হাত দিয়েই এটি শুরু হয়েছে। সত্যজিতের “হীরক রাজার দেশে” ছবিতে “মোরা দুজনাই রাজার জামাই” গানটিতেও এমনই পূর্বাভাস আছে। তবে রূপক এর যায়গায় ঋতু আসলেই অনন্য। কেমন করে? ঠিক ঋতুর মতই trailer বা শিরোনাম দিয়ে এই লেখাটি শেষ করি। বাকি তো রইল আরও অনেক ভাববার, বলবার।

২০০৩ এ ঋতুর “Raincoat” মুক্তি পেল। O.Henry এর সেই বিখ্যাত ছোটগল্প “The gift of the Magi” থেকে অভিযোজিত। ততদিনে ঋতু আর দেবজ্যোতির দৃশ্য আর শ্রুতিতে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে। ঋতু দারুণ সব lyric লিখছে, দেবজ্যোতি দিচ্ছে সুর আর সঙ্গীত। গাইছে সব মাস্টার গাইয়েরা। আর সেইসব গান ঋতুর ছবির শিরোনামে এসে এমন এক dimension দিচ্ছে, যা সত্যজিতের (বোম্বাইয়ের বোম্বেটে) ভাষায়, “হলে দর্শকদের বুকে বিঁধে পায়রা উড়িয়ে দিচ্ছে।” তো এই ছবির শীর্ষসঙ্গীত ছিল “মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও?” অর্থাৎ, “মথুরার রাজা, তুমি কেন গোকুল যাচ্ছ?” গানটি ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা, ব্রজবুলি ভাষায়। ঋতুর উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল খুব। রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ছদ্মনামে ব্রজবুলিতে অনেক পদাবলী লিখেছেন। ঋতু তাঁর “আবহমান” ছবিতে সেসব কিছু ব্যবহারও করেছেন।

তাঁর পিতা সুনীল ঘোষও ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

যারা রেইনকোট দেখেছেন তাঁরা জানবেন যে ছবিটি এক অসমাপ্ত প্রেমের বিচ্ছেদ ব্যাখ্যান। দুই মানব মানবীর অপরিণত প্রেমের যতিচ্ছেদে এক দীর্ঘ বিরহের না দেখা সময়প্রবাহ। তবে মথুরার রাজার উল্লেখ কেন? কারণ, কংসকে উৎখাত করে মথুরার কুলপতি হলেন গোঠের রাখাল কৃষ্ণ। আর তারপর কখনও তিনি গোকুলে ফেরেননি, যেখানে রাধা থাকতেন, যেখানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কিংবদন্তী রচিত হয়েছিল। অনেকেই জানেননা যে, যদুকুল মুখ্য হওয়ার পর কৃষ্ণ আর কখনওই রাধাকে দেখা দেননি। ঋতু নারীমন বুঝতেন। তাই রেইনকোটে যখন জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ অজয় দেবগন স্রেফ নিজের জীবনটাকে অন্তত একটু গড়ে তোলার জন্য হলেও তার বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে কোলকাতা রওনা হয়, তখন ঋতু তীব্রস্বরে প্রশ্ন করেন, “কেন? আজ কেন যাচ্ছ? সেই শহরে, যেখানে সে তোমার তীব্র অবহেলায় বেঁচে থাকে?” দেবজ্যোতির সুর আর সঙ্গীতে এবং শুভা মুদগালের অনির্বচনীয় গায়কীতে গানটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক সম্পদ হয়ে ওঠে নিমেষেই।

লেখনীর শুরুর গীতিকাব্যটিও ঋতুর লেখা। তারই “খেলা” ছবির শীর্ষ বা শিরোনাম সঙ্গীত। আরো অনেক কথা রইল। দেখা হবে আবারও ঋতুরাগে।