বিদায় চেস্টার। ইন দি এন্ড, ইট রিয়েলি ডা’জ ম্যাটার!

সময়টা ২০০০ সাল। নিউ মিলেনিয়াম টার্মটার যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে, অডিও ক্যাসেটের যুগ শেষের দিকে, বাড়িতে বাড়িতে ‘পিসি’ ঢুকছে আর তাতে করে টিনেজার ছেলেপুলেদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পিসি গেমিং। অবশ্য ঢাকার ব্যাকডেটেড অঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবারের টিনেজে পা রাখা এক কিশোরের মনে স্বাভাবিকভাবেই ওই ট্রেন্ডি বিষয়আশয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মালেও বাসার বজ্র আঁটুনিতে ওসবের প্রবেশাধিকার নেই। তাই তখনকার প্রেক্ষাপটে মোটামুটি স্বাধীনতাভোগী তারই এক কাজিনের বাড়িতে ওই এক্সপেরিয়েন্স নেয়ার এক পর্যায়ে নানাবিধ মারকাটারি গেমের সিডির ভিড়ে আমেরিকান ব্যান্ডদলটার একটা অ্যালবামের সাথে প্রথম পরিচয়। এমিনেম বা ফিফটি সেন্টের মতো আপাত নিষিদ্ধ আকর্ষণ ওতে নেই, তবু গানগুলো আর মিউজিক সিডির মধ্যে কিছু একটা ছিলো যা আটকে গেলো ছেলেটার মাথায়। লিংকিন পার্ক-হাইব্রিড থিওরি। অর্থ বোঝেনি। কেনো এমন নাম সেটাও মাথায় ধরেনি। কিন্তু গান শুনে আর সিডি কাভার উল্টেপাল্টে মনে হয়েছিলো, হুম এমন ব্যান্ডের নাম এমনটাই তো হওয়া চাই। গুগোল তখন চাইলেই হাতের নাগালে পাওয়া যেতো না। তাই নামটা কেনো লিংকিন পার্ক তা তখন জানা হয়নি। তাতে বয়েই গেছে। ছেলেটা তো অলরেডি হয়েই গেছে লিংকিন পার্ক ব্র্যান্ডের লয়াল ফলোয়ার। এ-ও মনে আছে, কোনো সুযোগে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেলে ইন্টারনেট দেখে খাতার পেছনে ওদের গানের লিরিকস লিখে রাখতো সে। এমপিথ্রি প্লেয়ারে ভরবার জন্য ইউনিভারসিটির ল্যাবে লুকিয়ে লুকিয়ে গান ডাউনলোডও করতো। ব্যান্ডের গানের জনরা বুঝেছিলো গান শুনতে শুনতে। আস্তে আস্তে বাকি মেম্বারদের সাথেও পরিচয়। তাজ্জব বিষয় হলো এরপর অর্ধযুগ পেরিয়ে যাবার আগে ব্যান্ডটির একটা মিউজিক ভিডিও-ও দেখা হয়নি তার। শুধু গান শুনে আর সিডি কাভার দেখেই পরিচয়। প্রথমবার মিউজিক ভিডিও দেখে অবশ্য ভোকাল, গিটারিস্ট বা ড্রামার নয়, বেশি জোস লাগতো এশিয়ান চেহারার মেম্বারটিকে (জো হান)। ডিজে কালচার তখন রমরমা। তাই টার্নটেবিলের পেছনে প্রচুর এনার্জেটিক মিউজিশিয়ানটারই নজর কাড়বে এটাই স্বাভাবিক। একটু পরে খেয়াল হলো বাকিদের এনার্জিও কম নয়।

ওর একই বয়সী ছেলেরা যখন মেটাল, থ্রাশের ‘কঠিন-মরণ’ ভক্ত, (সে-ও যে শুনতো না তা নয়, তবে বন্ধুদের মতো ডাইহার্ড ফ্যান হওয়া হয়ে ওঠেনি) ওর এমপিথ্রি প্লেয়ার মোস্ট প্লেইড সংলিস্টে ওই ঘুরেফিরে নাম্ব, ক্রলিং, ইন দি এন্ড-ই আসতো। লিড ভোকাল চেস্টার বেনিংটন, মাইক শিনোডার কণ্ঠ তার কৈশোরের কান আর মাথার এতো বেশি অংশ নিয়ে রেখেছিলো তাতে করে তরুণ বয়সের অনেক অপ্রাপ্তি, হাহাকার মাথায় ঢুকলেও মিউজিকের দাপটে বেশিক্ষণ টিকতেই পারেনি। লিংকিন পার্কের অল্টারনেটিভ, ইলেকট্রনিক আর র‌্যাপ রক, কিংবা নিও মেটাল ঘরানার গানই তার কাছে তারুণ্যের সিনোনিম। ওতেই সে খুঁজে পেতো বাঁধভাঙার উদ্যম। আর এই বিষয়টা বিশ্বের আরো অনেক মিলেনিয়াম টিনেজারের সাথেই মিলে যাবে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হবে শুধু।

সোর্সঃ টুইটার

অথচ সময় কতোটা নির্মম দেখুন। সেদিনের ওই লিংকিন পার্ক ভক্ত একসময় জীবন আর যাপনের চিন্তায় এখন এতোটাই আটকে গেছে, এ বছর ব্যান্ডের সাত নম্বর স্টুডিও অ্যালবাম রিলিজ পেয়েছে তার একটাও নাকি তার শোনার সময় হয়নি। সময় মানুষের মুগ্ধতায়, ভালোলাগার মোহে একটা পুরু প্রলেপ ফেলে ঠিকই, কিন্তু কোনো একদিন সকালবেলা উঠে সেদিনের সেই কিশোরটাই যখন প্রিয় ভোকালের মৃত্যুসংবাদ পায়, হাজারো ব্যস্ততা, ফিরিস্তি আর অজুহাতের মাঝেও হঠাৎ একটা মন খারাপের বাতাস জোরালোভাবে ঠিকই টের পায়। চেস্টার বেনিংটন, নতুন মিলেনিয়ামের লাখো তরুণের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারা খাওয়া দিনগুলোকে সামান্য হলেও সহজ মনে করানো প্রিয় ভোকাল ২০ জুলাইটিকেই পৃথিবীতে নিজের শেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত করে রেখে গেছেন। ৪১ বছর বয়সে চলে গিয়েছেন আরিজোনায় জন্ম নেয়া এই মিউজিশিয়ান। আর বিদায় নেয়ার জন্য কোন দিনটিকে বেছে নিলেন দেখুন। প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মিউজিশিয়ান, অনুরাগী ক্রিস করনেলের জন্মদিনটিকে। মে মাসে করনেলের আত্মহননে বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন চেস্টার। খোলা চিঠিতে নিজের আবেগ প্রকাশও করেছিলেন। সেটা দিয়েও কাঁদিয়েছিলেন অনেককে। কিন্তু তাই বলে করনেলকে এভাবে অনুসরণ করে সবাইকে আক্ষরিক অর্থেই ‘নাম্ব’ বানিয়ে কাজটি কি ঠিক করলেন চেস্টার? লাউড স্পিকারে আপনার গলা শুনে আনমনেই হেড ব্যাং করা নাইন্টিজ কিডদের কথা কি একবারও ভাবতে ইচ্ছে করলো না?

প্রিয় চেস্টার বেনিংটন, ক্রিস করনেলের বিদায়টাই মেনে নেয়া কঠিন ছিলো। আপনারটা আরো বেশি ভোগাবে, সন্দেহ নেই। হয়তো মহাজাগতিক ব্যাপারস্যাপারের প্রেক্ষিতে দু-একটা মানুষের চলে যাওয়ার বিষয়টি খুবই ক্ষুদ্র। আফটারঅল, অন্য এক প্রেক্ষাপটে আপনারাই তো শিখিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত কিছুই যায় আসে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক্ষেত্রে ইন দি এন্ড, ইট রিয়েলি ডা’জ ম্যাটার।

বিদায় চেস্টার। হালজামানার স্টাইলে বললে বলতে হয়, থ্যাংকস ফর মেকিং মাই টিন এইজ অ’সাম। একটা জেনারেশন নাকি গড়ে ওঠে পাঁচ বছরে। তাহলে আপনি তিন তিনটি জেনারেশনকে সার্ভ করেছেন। থ্যাংকস ফর এভরিথিং। ও হ্যাঁ, সকাল থেকে এই ভিডিওটি যতোবার দেখছি ততোবারই  গু’জবাম্প হচ্ছে। আমি নিশ্চিত আমার মতো অনেকেরই হচ্ছে এমন। কেনো হচ্ছে এমনটা? বলতে পারবেন চেস্টার?