ফাদার যেভাবে ড্যাড হলেন

সময় যায় । শীতে গাছের পাতা ঝরে। পুরনো শহর ভাঙে, গড়ে ওঠে নতুন শহর। পুরনো শব্দের গায়ে লেগে থাকা চুন সুরকি খসে সেটা হয়ে ওঠে নতুন শব্দ। ‘চন্দ্র’ তার পায়ে লেগে থাকা চরকারসুতো ফেলে দিয়ে ওপরে চন্দ্রবিন্দু নিয়ে বসে যায়। ‘হস্ত’ প্রথমে হয় হত্থ, আর তারপর সব জটিলতা ঝেড়ে ফেলে বনে যায় হাত-এ। সুবর্ণলতার দন্ত্য স, তার পাশের ‘ব’কে পিষে ফেলে স্বর্ণলতাহয়েযায়। আর ফাদার হয়ে যায় ড্যাড।

হোয়াট!!

দুটো শব্দে কোনো ধরনের মিল নেই। ধ্বণির দিক থেকে ইংরেজি মাদারের সাথে ‘মম’ এর মিল আছে, কিন্তু ফাদারের সাথে ড্যাডের সেই মিল কই? তাহলে রাশভারি ফাদারেরা কিভাবে ‘ড্যাড’ হয়েউঠলেন? কারা এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের জন্য দায়ী?

এদের ডাকেই ফাদার হলেন ড্যাড।

উত্তর একটাই, আন্ডা বাচ্চার দল। হাফিংটন পোস্টের ব্লগার টনি বাকসবামের কাছে যাওয়া যাক। ফাদার এবং ড্যাডের মধ্যে দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে সীমারেখা টানছেন তিনি – ‘আমি সবসময়েই এটাভেবেছি যে, কেবল সন্তান জন্ম দেয়ার সাথে সাথেই যে কেউ ‘ফাদার’ হয়ে যেতে পারে। তবে সন্তানকে বড় করে তোলার পুরো প্রক্রিয়াটার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন একজন ‘ড্যাড’।

ড্যাডের উৎপত্তি খোঁজার আগে আপনাদের নিয়ে প্রথমে ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া যাক। ডেন্টিস্টের চেম্বারের হেলানো চেয়ারে শুয়ে আছেন, আপনার মুখে হয়ত পানির নল কিংবা আরো কিছুলাগানো। ঠিকমত কথা বলতে পারছেন না। এসময় কথা বলার চেষ্টা করলে আপনার মুখ দিয়ে প্রথমে যে ধ্বনিগুলো বেরোবে, তা অনেকটা এরকমঃ ‘পাহ’, ‘বাহ’, ‘কাহ’ ‘দাহ’ ‘মাহ’ ইত্যাদি। অর্থাৎমুখের ভেতরের বাতাসটা বাইরে ঠেলে দিচ্ছেন কেবল, সেটাই বিভিন্ন জায়গায় ধাক্কা খেয়ে এইসব এলোমেলো ধ্বনির সৃষ্টি করছে। ঠিক এভাবেই হাজার বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে জন্ম নেয়া আন্ডা বাচ্চারদল জন্ম দিয়েছে মা, মম এবং বাবা কিংবা ড্যাড-দের। অক্সফোর্ড ডিকশনারিস-এর কন্টেন্ট ক্রিয়েশন বিভাগের প্রধান ক্যাথেরিন কনার মার্টিনের কথা শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘মা এবং বাবার জন্য গোটাদুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় যে শব্দগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এর কারণ একটাই। মানবশিশু ঠিক এভাবেই নিজেদের মুখ দিয়ে ধ্বণি সৃষ্টি করতে শুরু করে। মুখ থেকেবাতাস ঠেলে দেয়া এবং সেই বাতাসকে ঠোঁটে চেপে ধরে নানা রকম ধ্বণি তৈরি করে শিশুরাঃ মা, মামা, পাপা, আব্বা, বাবা, ডাডা, দাদা ইত্যাদি। ড্যাড শব্দটা সেই ডাডারই একটু পরিশীলিত রূপ।’

সন্তানের মুখেই জন্ম হয় একজন ‘ড্যাড’ এর

ইংরেজি ভাষায় লিখিত রূপে প্রথম ‘ড্যাড’ শব্দটি ব্যবহারের নজির পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে। ‘মম’ এঁর নজির খুঁজে পেতে হলে যেতে হবে আরো সামনে, ঊনবিংশ শতাব্দীর কিছু লিখিতসাহিত্যে, যেখানে Momma বা মমা এর সংক্ষেপিত রূপ হিসেব ‘মম’ (Mom) ব্যবহৃত হয়।

শব্দ সমার্থক হলেও ‘ফাদার’ থেকে ‘ড্যাড’ হয়ে ওঠার পথটি বন্ধুর।

ড্যাডের উৎপত্তি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া গেলো। এবার ‘ফাদার’ সম্পর্কে আরো কিছু অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করা যাক।ইংরেজি লিখিত সাহিত্যে ফাদারের নজির বহু পুরনো। ত্রয়োদশ শতাব্দীরও অনেক আগে ‘ফাদার’ শব্দ হিসেবে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কথা সেটা নয়। ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে ‘ফাদার’ শব্দটির গুরুত্ব অনেক। এই একটা শব্দই প্রথমবারের মত প্রাচ্য এবং পশ্চিমের ভাষাগত মিল খুঁজে পেতে ভাষাতাত্ত্বিকদের উৎসাহ দেয়। মূলত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় মিলেরব্যাপারটি ভাষাতাত্ত্বিকদের চোখে পড়তে থাকে। প্রাথমিকভাবে ফরাসি, পর্তুগিজ, ইংরেজি, ইটালিয়ান ইত্যাদি ভাষার নিজেদের ভেতরকার মিল খুঁজে পান তাঁরা এবং বুঝতে পারেন, এই ভাষাগুলোরপ্রত্যেকটির উৎসই ল্যাটিন। কিন্তু ১৭৮৬ সালেই প্রথমবারের মতো, ভাষাতাত্ত্বিকদের মনে হয়, শুধুমাত্র ইউরোপের ভাষাগুলোই যে একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত, তাই নয়, পৃথিবীর এ পার এবং ওপারে অর্থাৎ প্রাচ্য এবং পশ্চিমে যে ভাষাগুলো চালু রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের উৎপত্তিই আসলে একই ভাষা থেকে। সময়ের বিবর্তনে সেই উৎস ভাষা হারিয়ে গেছে, কিন্তু একই উৎসের স্মৃতি বহনকরে ঘুরে ফিরছে প্রত্যেকটি ভাষা।

সংস্কৃত, ল্যাটিন এবং গ্রিকঃ দূরত্ব অনেক হলেও পিতায় পিতায় বেশ মিতালি

এই যে যুগান্তকারী আবিষ্কার, এর সূচনা কিন্তু ‘ফাদার’ এর হাত ধরেই। ব্রিটিশ পণ্ডিত স্যার উইলিয়াম জোনস সংস্কৃত ভাষা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। ১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে দেয়াএক বক্তৃতায় তিনি প্রথম আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, পিতৃসম্পর্ক বোঝাতে ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ ‘পিতার’ এর সাথে ল্যাটিন এবং গ্রিক ‘প্যাটার’ এর সাংঘাতিক মিল রয়েছে। এরপর প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যেরঅন্যান্য শব্দে মিল খুঁজে বের করতে শুরু করেন ইউরোপের ভাষাতাত্ত্বিকরা। আর এভাবেই বাবারা খুলে দিলেন ভাষা সম্পর্কে ভাবার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির।

সাকিব আল হাসান

ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস না ঘেঁটে একটা সুন্দর স্মৃতি দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। স্মৃতিটা হাফিংটন পোস্টের ব্লগার টনি বাকসবামের। নিজের ব্লগে টনি লিখেছেন, আমার প্রথম সন্তান জন্মায় ১৯৯৬সালে। ওর জন্মের আগে আমি আর আমার স্ত্রী উদ্ভুত একটা কাজ করতাম। বিকালে ঘরের অন্যান্য কাজ শেষে আমার স্ত্রী সোফায় বসে বিশ্রাম নিতো, আর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেটের দিকে ঝুঁকেআমার অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলতাম- কিভাবে ওর জন্য আমরা আলাদা একটা রুম তৈরি করছি, কিভাবে সেটা সাজাচ্ছি, কি কি কিনছি ইত্যাদি। এর অনেক পরে ২০১৩ সালে একটা বৈজ্ঞানিকগবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, গর্ভাকালীন অবস্থাতেই বাচ্চারা শব্দ এবং গলার চিনতে শুরু করে। এই গবেষণা তখন না থাকলেও আমি বিশ্বাস করতাম, চামড়ার পাতলা দেয়ালের ওপাশে থাকা আমারসন্তান মনোযোগ দিয়ে কান পেতে আমার কথা শুনছে। যথারীতি প্রসবের দিন এলো। সন্তান দুনিয়ার আলো দেখবার পরেই তার সে কি কান্না। রিকভারি রুমে সদ্য পিতা হওয়া আমি হতভম্ভ হয়েসন্তানের চিৎকার শুনে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি না, কি করা উচিত। হঠাৎ কি মনে হতেই, আমি ওর দিকে ঝুঁকে কথা বলতে শুরু করলাম। মনোযোগী শ্রোতার মতো আমার প্রথম ছেলে, জেরেমি কান্নাথামিয়ে দিলো। আমার কাছে মনে হলো, গলার স্বরে ও যেনো কোন পরিচিত জনের সন্ধান পেয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, সন্তান জন্ম দিয়ে ফাদার হওয়ার অনেক আগেই আমি ওর ‘ড্যাড’ হয়েগেছি।
Sources:
http://time.com/4369110/fathers-day-dad-word-etymology/
http://www.huffingtonpost.com/tony-buchsbaum/when-does-a-father-become_b_9573946.html
http://mentalfloss.com/article/65261/how-word-father-unlocked-history-language