চে, তোমার ইমেজ আমাকে পুঁজিপতি করে দেয়

১.

ক)

লন্ডনের গ্রেট কুইন স্ট্রিট।

ক্লাসিক আর্ট ডেকো স্ট্যাইলের আইকনিক ফ্রিম্যাসন হল তখন কানায় কানায় পূর্ণ। অবশ্য লেটারস্ লাইভের যেকোনো আয়োজনে মানুষজন হুমড়ি খেয়েই পড়ে। স্বভাবতই সামনের ৮০ পাউন্ডের সিট সবার আগেই শেষ হয়েছে, জর্জ বাধ্য হয়ে নিজের ও এ্যানার জন্য নিয়েছে ৫৫ পাউন্ডের টিকিট।

রাসেল ব্রান্ড মঞ্চে আসবে এখন। লম্বা, বন্য আবেদনের এই কমেডিয়ান-অভিনেতার অসম্ভব ভক্ত এ্যানা। হাতের ১২ পাউন্ডের স্যান্ডুইচে আরেকটা কামড় বসাতে না বসাতেই ব্রান্ড মঞ্চে উঠে পড়েন। কোনো রকমে টুকরোটা গলায় ঢুকিয়ে চিৎকার করে ওঠে এ্যানা। জর্জের মজাই লাগে।

ব্রান্ড হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। অনেকটা নিচুতে রাখা মাইক্রোফোনটায় কথা বলার জন্য, লম্বা মানুষটা তার দু’পা দু’পাশে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের উচ্চতা কমিয়ে আনেন। অন্ধকারের বিপরীতে আলোয় থাকা ব্রান্ডকে কেমন যেন এক অপার্থিবতা ভর করে। চে’র সন্তানদের কাছে লেখা শেষ চিঠিটা তিনি পড়তে শুরু করেন।

সবমিলিয়ে ২ মিনিটের কাছাকাছি। কিন্তু অদ্ভুত এক আবেগে এ্যানা ভেসে যায়। জর্জের হাতটা সে সজোরে চেপে ধরে। জর্জ ফিরে দেখে এ্যানার চোখ ছলছল করছে। কিন্তু তালি দিতে দিতে সে উঠে দাড়ায়। চে’র সন্তানদের প্রতি “গ্রো আপ এ্যাজ গুড রেভল্যুশনারি”র আবেগ তাকে জাগিয়ে তুলেছে।

খ)

রোস্যারিও, আর্জেনটিনা।

ফ্ল্যাগ মেমোরিয়ালের সামনের রাস্তাটা জনাকীর্ণ। আজ ২০ জুন। ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ডে। কিছুক্ষণ পর র‌্যালি শুরু হবে।

কিশোর আলেস্যান্দ্রো বেশ সকাল থেকে টি-শার্ট ফেরি করছে। তার বড় ভাই রিকুয়েলও একসময় টি-শার্ট ফেরি করতো। রিকই তার ফেরির গুরু। সে স্যান্দ্রোকে একটা জিনিস হাতে কলমে বুঝিয়েছে। জিনিস ভালো হলে তার দামও ভালো পাওয়া যায়। টি-শার্টের স্টিচটা খুব জরুরি। পাইকারি মার্কেট থেকে কেনার আগে প্রতিটা ফোঁড় তাই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এই যত্নের জন্যই প্রথমে একজন ট্যুরিস্ট তার কাছ থেকে জিনিস কিনলে আরো ক’জনকে তারই কাছে নিয়ে আসে। আর ঠিক তখনই দামটা চড়িয়ে দেয় সে।

একঝাঁক জাপানি টুরিস্ট এগিয়ে আসছে। সে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। তারা মেসি, ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের সাথে ক’টা চে গুয়েভারার টি-শার্টও নেয়।

আর্জেন্টিনা থেকে কিউবা, লন্ডন থেকে ম্যানিলা- চে রয়েছেন, টিশার্টে

একটা মজার জিনিস খেয়াল করেছে সান্দ্রো। রিকের সময় ছিলো ম্যারাডোনা, আর এখন যেমন মেসি বেশ চলে। কিন্তু চে-ছাপ্পা মারাগুলো সবসময় অল্পস্বল্প চলতেই থাকে, রিকে’র সময়েও এমনটাই ছিলো। মাত্র দু’সপ্তাহে সাড়ে ছয় ডলারের চে’র টি-শার্ট সব প্রায় গুলো শেষ। সে ভাবে আরো বেশ কিছু দ্রুত স্টক করে ফেলতে হবে। এই লোকটার চাহিদা যেন শেষই হয় না।

গ)

আজিজ মার্কেট, ঢাকা।

শোভন তার জন্মদিন উপলক্ষে ‘ছিল্’টা খেয়ে ‘অন্তর’ থেকে বের হয়েছে। বাগেরহাটের মফস্বল সংবাদদাতা বাবার পাঠানো টাকা কটা’র সাথে টিউশনি থেকে পাওয়া টাকাগুলোর বড় অংশটাও ফিনিশ।

ভিতর থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরাতেই সামনে পড়ে এলাকার এক বড় ভাই-এর, যিনি এখন বিজ্ঞাপনী অফিসে চাকরি করেন। সিগারেট লুকাবে না কি করবে এই অবস্থাতেই ভিতর থেকে অন্যরাও বেরিয়ে আসে। কিছু বোঝার আগে করবী তার অবাধ্য চুলগুলোর উপর লাল স্টার ওয়ালা গাঢ় শ্যাওলা রঙের একটা ব্যারেট পরিয়ে দেয়। “এটা পরে মিছিলে যাস”- করবী বলে, আর হেসে ওঠে সবাই।

শোভনের লাল-নীল-বেগুনী অবস্থা দেখে এলাকার বড় ভাইও বেশ মজা পান। এগিয়ে এসে পকেটে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ভিতরটা দেখেন। তারপর শোভনকে গিয়ে বলেন- “আশে পাশে তো দোকান নেই। ১১ টা আছে। শুভ জন্মদিন।” তারপর হাসতে হাসতে নিজের বন্ধুদের নিয়ে ‘অন্তরের’ ভিতরে ঢুকে পড়েন।

এলাকার সিনিয়রের কাছ থেকে পাওয়া সিগারেট আর বহুদিন ধরে খুঁজে ফেরা চে-ব্যারেটটা করবীর কাছ থেকে পেয়ে ওর মাথার একদম এলোমেলো অবস্থা।

এ দু’টো তো আসলে শুধু উপহার নয়; বড় ভাইর কাছ থেকে বড় হবার অভাবনীয় এক স্বীকৃতি এবং সাথে করবীর কাছ থেকে অন্য বিশেষ একটা কিছুর স্বীকৃতিও।

এই লাল তারকা কতজনকে জুগিয়েছে বিপ্লবের রসদ

ব্যারেটটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে শোভন আর নিজেকে মোটরসাইকেল ডায়েরিজ-এর গার্সিয়া বার্নেলের জায়গায় কল্পনা করে।

২.

খণ্ড ছবিগুলোর স্থান-কাল-পাত্র সব আলাদা; খানিকটা সত্যি, খানিকটা কল্পনা । কিন্তু একটা জিনিস এদের মধ্যে কমন। চে, আর্নেস্টো রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সর্না।

পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে মানুষ কোক বা টম এন্ড জেরির মতো, চে’কে বা তার ছবিকে চেনেনা। যার পরিচয় এখানে দেওয়াটা একদম অপ্রয়োজন। বিপ্লব, প্রতিবাদ, রুখে দাড়ানো, দরিদ্র-সর্বহারা মানুষ আর সমাজতন্ত্রের সমার্থক তিনি।

কিন্তু খণ্ড ছবিগুলোর মধ্যে আরো একটা জিনিস কমন। বেচা-বিক্রি মানে সহজ কথায় অর্থের উপস্থিতি।

অর্থের বিনিময়ে চে বিক্রি হচ্ছেন। মানে তার চেহারা বিক্রি হচ্ছে।

৩.

মার্কিন (সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক) কোম্পানি কনভার্স তাদের এক জুতার বিজ্ঞাপনে চে’র ছবি জুড়েছে!!

জুতোর দোকানির চে বিক্রয়

বৃটিশ (নিপাত যাক নিপাত যাক) কোম্পানি স্মিরনফ (যারা রাশিয়ার গর্ব ইয়ে বানানোটাও বিলেতে সরিয়ে নিল) তাদের বোতলে চে’র ছবি বসিয়েছিল।

স্মিরনফের বোতল থেকে সরানো গেলেও রামের বোতলে স্বমহিমায় চে

জার্মান (ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক) ক্যামেরা কোম্পানি লাইকা বিজ্ঞাপনে তার লাল তারকাখানি ঝেড়ে দিয়েছিল।

মার্কিন(ঐ) কোম্পানি ট্যাকো বেল তাদের ম্যাসকট চিহুয়াহুয়াকে (ছোট্ট আদুরে একখানা কুকুর) চে’র সাজ দিয়ে ছিল।

ট্যাকো রেভল্যুশনের ডাক দিয়েছিল ট্যাকো বেল

ফ্রেঞ্চ (লে কনফিউসোবাদ!!!) সুপার বড়লোকি রোদচশমা কোম্পানি জ্যঁ পল গুটিয়ে নিজেদের প্রচারণায় তাকে আঁকলো।

জার্মান (ঐ) মার্সিডিজ তার মার্কিন (ঐ) মুলুকের প্রিমিয়াম লাক্সারি গাড়ির প্রচারেও চে’কে ধরলো।

মার্সিডিজ করবে বিপ্লব!! আইকন চে!!

ইউনিলিভার অস্ট্রেলিয়ার চে আইসক্রিম, ফ্রান্সে চে কোলা, চে সিগার, ক্যাফে, বার, নাইট ক্লাব- কি নেই তার নামে। এমন কি আমাদের যায়যায়দিন পত্রিকা অফিসেও একখানা চে ক্যাফে ছিল।

ব্র্যান্ডিং মাহাত্ম্যে চে কোলা পাল্লা দেয় কোকাকোলা আর পেপসির সাথে

স্যুভেনির-জামাকাপড়ের কথা বাদ দিলাম, ব্রাজিলিয়ান বিকিনি বা মধ্যপ্রাচ্যের হিজবুল্লার পোস্টার, প্যারিস থেকে পারস্য- ব্রাসেলস থেকে বরিশাল কোথায় নেই তিনি।

কে বেঁচে না আর, কে কেনে না তাকে।

বিলিয়ন ডলারের ব্র্যান্ড(নাউজুবিল্লাহ্, পুঁজিবাদী শব্দ) ভ্যালু তার এখন। তা হলে খাড়াইলোটা কি?

“মোরা কমিউনিজমের লাগিয়া এ ছবি আঁকিনু,

ক্যাপিটালিজমে খাইয়া গেল…???!!!”

কেমনে ?

৪)

১৯৬০ সালে হাভানা বন্দরে এক অস্ত্রবহনকারী জাহাজে বিষ্ফোরণ ঘটে ৮০ জন নিহত হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার জন্য সিআইএ তথা আমেরিকাকে দায়ী করেন।

৫ মার্চ নিহতদের অন্তেষ্টিক্রিয়ার দিন প্রতিবাদী বিক্ষোভ থেকেই ফটোগ্রাফার আলবার্তো কর্দা, চে গুয়েভারার বিখ্যাত ছবিখানি তোলেন। মূল ছবিতে যদিও চে’র মুখোমুখি আর এক ব্যাক্তি ছিলেন, তাকে পরে কেটে বাদ দেন ফটোগ্রাফার। ছবিটি কর্দার স্টুডিওর দেয়ালে প্রচারহীন ভাবে ঝুলে ছিল অনেকদিন।

১৯৬৭’র অক্টোবরে চে’কে হত্যা করা হলে আইরিশ আর্টিস্ট জিম ফিৎজপ্যাট্রিককে তা প্রচন্ড আলোড়িত করে তোলে। আদর্শের জন্য একটা মানুষ জীবন দিয়ে দিলো; একটা আইডিয়াল আইকন হতে চাইলে আর কি চাই ! তিনি কর্দার তোলা ছবি থেকে তার কিংবদন্তীর আইকনিক ছবিটা এঁকে ফেলেন।

ফিৎজপ্যাট্রিকের আঁকা আইকনিক চে

আর শুধু আঁকলেনই না, বর্তমানের ভাষায় তাকে ‘ভাইরাল’ও করে দিলেন।

৫.

একটা পণ্য তার বিক্রির সুবিধার জন্য একটা আদর্শ মানুষের মতো চরিত্র হতে চায়। সহজ ভাবে, হয়ে ওঠা এই চরিত্রটাকেই আমরা ব্র্যান্ড বলি।

এর মানে হচ্ছে প্রতিটা ব্র্যান্ডেরই একটা আদর্শ বা জীবন দর্শন থাকে।

সেই দর্শনের প্রকাশ থাকে তার আচার-আচরণ, পোষাক-আশাক, কথাবার্তায়। এবং এই প্রকাশ ভঙ্গিটা হুটহাট বদলে যায় না। ফলে সহজেই তাকে ওই নির্দিস্ট ব্র্যান্ডের বৈশিষ্ট্য হিসাবে শনাক্ত করা যায়।

এই কাজটাই যখন একদম ঠিকঠাক ভাবে হয়, তখনই পণ্যটা একটা আদর্শ মানুষের চেহারা নেয়। সে একটা শক্তিশালী ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত হয়।

প্রতিটি পণ্য যেখানে একজন মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে, চে’তো সেখানে একটা আপাদ-মস্তক সুদর্শণ পুরুষ মানুষ। যার রূপ-গুণ, জীবন দর্শনে আর বিপ্লবের জন্য নিজের জীবন দান করাতো শৈশবে শোনা রূপকথার মতোই সকল মানুষের প্রিয়।

প্রতিটি পণ্যকে যেখানে একটু একটু করে মানুষের প্রিয় হয়ে তারপর একটা ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে হয়। চে’তো তো পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের প্রিয় এক নাম।

বলা যায় তিনি প্রতিটি ব্র্যান্ডেরই আদর্শ কিংবা নিজেই একটি আদর্শ ব্র্যান্ড।

শুধু একটা এ্যাসট্রিক্স আছে। মানে শর্ত প্রযোজ্য।

স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে রক্ষা করা যেমন কঠিন, ভালো ব্র্যান্ড বানানোর চাইতে তাকে টিকিয়ে রাখাও তেমন কঠিন।

৬.

ক)

কপিরাইট জিনিসটা একটি সাম্রাজ্যবাদী ব্যক্তিপুঁজি প্রসারের হাতিয়ার। সমাজতান্ত্রিক কিউবার কাছে যা সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাজ্য। চে’র ছবির তাই কোনো কপিরাইট রইলো না। যে কেউ চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে।

খ)

ষাট-সত্তরের দশকে সারা পৃথিবীর তরুণদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ভাবনায় একটা ‘পরিবর্তনে’র চাহিদা তৈরি হয়। ফিদেল ও অন্যান্য কম্যুনিস্ট নেতারা তাদের কাছে তখন সমাজতন্ত্র গছাতে চাইলেন। তারই ব্র্যান্ড এ্যাম্বেসেডর হিসাবে, আদর্শের জন্য জীবন দেওয়া, বিপ্লবী চে’র চাইতে আর ভালো বিকল্প আর কিই বা হতে পারে? তারা চে’র আইকনিক ছবিখানির প্রচার ও প্রসার ঘটালেন।

এই সেই ছবি যা চে-কে দানিয়াছে আইকনের সম্মান

গ)

বিবিধ কৌশল, প্রয়োজন ও পরিস্থিতিতে পড়ে ফিদেলরা কিউবা’র জন্য নতুন এক কান্ট্রি ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। মানে সমাজতান্ত্রিক কিউবার নাম শুনলে মানুষ যেন সমাজতন্ত্রের ক্যাপিটাল(পুঁজি নয়, রাজধানী) মস্কোর ছাতা থুড়ি লেলিন-স্তালিন-ক্রেমলিনের গম্বুজের ছবি না ভেবে একটা সম্পূর্ণ নতুন আইডেন্টিটি খুঁজে পায়। যা হবে তারুণ্য, রোমান্টিসিজম আর বিপ্লবের নতুন এক চেহারা।

চে’র মৃত্যুর পর সচেতনভাবে তারা সেটি প্রচারও করলেন। শোনা যায় জা পল সাত্রের হাত ধরে ইউরোপের মার্কেটে চে চালান হন, পোস্টার হয়ে। যেটি সাত্রে হাভানাতে বন্ধু ফিদেলের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।

ঘ)

এরমধ্যে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ফিদেলরা বিকল্প আয়ের পথও খুঁজছিলেন। চে’র ইমেজ সারা বিশ্বের তরুণদের মধ্যে তখন তুমুল জনপ্রিয়। হাভানাকে নস্টালজিক, রোম্যান্টিক, রেভ্যুলশনারি টুরিস্ট ডেস্টিনেশন করতে কিউবা সরকার উঠেপড়ে লাগলো।

দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চে’র চাইতে সহজ জিনিস আর কি হতে পারে। তারা চে’কে সারা বিশ্বের হাতে কোনো শর্ত ছাড়াই তুলে দিলেন।

ঙ)

পুঁজিবাদ অতীব চতুর এবং কিঞ্চিত তরলা। তার বৃদ্ধি-বিস্তারের প্রয়োজনে যে সময় যেমন দরকার ঠিক তেমন আকার ধারন করে নিতে পারে। কিন্তু সমাজতন্ত্রতো আর ছেলের হাতের মোয়া না! চাইলেই নতুন কোনো চিন্তা-ভাবনা বিবেচনার সময় কি তার আছে! তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া বা পরিমার্জিত ৩.০ ভার্সনে আপগ্রেড হবার সুযোগতো সাম্যবাদের একদমই নেই (কমপক্ষে তখন ছিলো না)।

ফলে সমাজতন্ত্রের ইমেজ চে একটা দীর্ঘ সময় পুরানো কথার চর্বিতচর্বন ছাড়া নতুন কিছু বলেনি। নতুন ভাবে, নতুন জায়গায়, নতুন প্রযুক্তি মাধ্যমের চিন্তাকে সে ধারণ করেনি। তাই পরের দিকে তার একটা আবেদন থাকলেও কার্যকারিতা ছিল কমতির দিকে।

নতুন সময়ের পুঁজিবাদ এই সুযোগটাই নেয়। সে চে’কে আস্তে-ধীরে তার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং একটা সময়ে তাকে তার মিত্রের চেহারাও দিয়ে ফেলে।

চ)

প্রচারের লাগাম পুঁজিবাদী-পতিদের হাতে। তাদের ইচ্ছতেই তার গতিপথ নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে সমাজবাদীদের সক্ষমতা খুবই নাজুক। ফলে চে আদর্শের জন্য একজন আত্মত্যাগকারী ব্যক্তির ইমেজ ফেলে সুপার যৌন আবেদনময়ী রোম্যান্টিক হিরো হয়ে উঠেছেন। যা দিনশেষে পুঁজিবাদেরই আদর্শ আইকন।

ছ)

তার তোলা ছবির, পুঁজিবাদীগণ কতৃক উপুর্যপরি ব্যবহারের এই হাল দেখে আলবার্তো কর্দা ২০০১ সালে ইয়ে কোম্পানি স্মিরনফ আর তার বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান লো লিন্টাসের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন; এবং জয় লাভ করেন। যদিও মামলা থেকে প্রাপ্ত পুরো টাকাটাই তিনি হাভানা চিল্ড্রেনস হসপিটালে দান করে দেন। এর ন’মাস পরে তার মৃত্যু হয়।

কর্দা কন্যা ডায়না ডিয়াস তার হঠাৎ প্রাপ্ত ধণভাণ্ডারের চাবি, মানে চে’র ছবির রাইট, বাবার ন্যায় অবিবেচকের মতো অবহেলা না করে, বর্তমান সময়ের বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে একদম ঠিকঠাক বুঝে নেন। তিনি বিশ্বের(পশ্চিমা) আইনের প্রতি সম্পূর্ন আস্থাশীল থেকে, ন্যায় নিষ্ঠাবান নাগরিকের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে (অবশ্যই যাতে বিকৃত না হয়ে চে’র ইমেজ যাতে সঠিক ভাবে ব্যবহার হয় তার জন্য) বর্গা দিচ্ছেন। কে, কি জন্য ব্যবহার করছে এটি বড় কথা নয়, ঠিকঠাক নিয়ম মতো অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করছে কিনা সেটিই সবচেয়ে জরুরি।

জ)

তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম বিশ্বে কপিরাইটের মাও নাই, তাই তার মাদারল্যান্ডও নাই।

ঝ)

লক্ষ্মীর কোনো জাত নেই। পুঁজিবাদী লক্ষ্মী আর সমাজবাদী লক্ষ্মীকে দেখে স্বয়ং নারায়ণও আলাদা করতে পারবেন না। ফ্রি’তে পাওয়া এই সুযোগখানি, চে’র ইমেজ ও আইকনের বেচা-কেনা, উভয় বাদী পক্ষই নিজের আপন মনে করে থাকেন।

৭.

পৃথিবীতে দীর্ঘ একটা সময় ধরে পুঁজি আর ধর্মের অশ্বমেধ যজ্ঞ চলছে। সে অশ্ব থামানোর সাধ্য কারই বা আছে! নায়কই হোক বা খলনায়ক, সর্বত্র তাদেরই বীরত্বগাথা। আর এ বসুন্ধরাতো (আলম বা শাহালম যারই হোক) বীর ভোগ্যা। চে’র আইকনটা তাই এখন সেই বীরদের দখলে।

সুতরাং নিশ্চিন্তে ধরেই নেওয়া যায় কমিউনিস্ট আইকনের ক্যাপিটালিস্ট রূপান্তরটা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে গেছে।

সো, রেস্ট ইন পিস কমরেড।

পুনশ্চ:

সুনীল, তোমার চে’কে নিয়ে কবিতাটা বড্ড প্রিয়।