অ্যাডভার্টাইজিংয়ে রবীন্দ্রনাথ

সহজভাবে বললে এখন শাহরুখ খান, বিরাট কোহালি বা সাকিব আল হাসান যা করছেন, সে যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা-ই করতেন। কেনো করতেন? কারণ ওই সময় তিনি বিরাট সেলিব্রেটি। ফেসবুকে ফলোয়ার-সংখ্যা গুনে গুনে হওয়া সেলিব্রেটি নন, আদতেই বিরাট। তা বুঝতে অবশ্য রবীন্দ্র-গবেষক হওয়া লাগে না।

যা হোক, বাজারে তার কাটতি ভালো ছিলো বলেই সে সময় ৯০টিরও বেশি পণ্যের বিজ্ঞাপনে এন্ডোর্সার হিসেবে যুক্ত হয়েছিলো কবিগুরুর নাম। ঘি থেকে শুরু করে মুখে মাখার ক্রিম, মিষ্টি থেকে হারমোনিয়াম, কবিগুরুর নাম পুঁজি করে বাজারে কী না বিকিয়েছে। তবে শুনতে যতোটা ‘খেলো’ লাগছে, ব্যাপারটা অতোটা নয়। হাজার হোক তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একমেবাদ্বিতীয়ম। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জমিদার। তিনি নিশ্চয়ই টাকার জন্য এন্ডোর্সমেন্টের কন্ট্রাক্টে সাইন করবেন না। (ওহ্ তখন অবশ্য এমন চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের মতো পেশাদার জগতে ভারতের বিজ্ঞাপন প্রবেশ করেনি। পুরো পৃথিবীতেই অ্যাড এজেন্সি তখন হাতে গোনা) আর তাইতো, সিম্পলি বিজ্ঞাপনে নিজের ‘ফেস’ জুড়ে দিয়ে ব্র্যান্ডের ভ্যালু অ্যাড করেননি তিনি। অংশ নেয়া বিজ্ঞাপনের কপিরাইটিংয়ের দায়িত্বটাও নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। সেটার নমুনা একটু পরে দিচ্ছি। জেনে রাখুন, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় স্বকীয়তা নিয়ে বিচরণের মতো বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজির হয়েছিলেন।

যা বলছিলাম- এক ধরনের রবীন্দ্রবিজ্ঞাপনে শুধু থাকতো পণ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এন্ডোর্সমেন্ট; যেখানে কবিগুরুর বাণীর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যটি গুণেমানে কেমন সেরা তা-ই বলিয়ে নিতেন। আর ওই বাণীর মধ্যেও পরিচয় মিলতো কবির সাহিত্যরসের। ওর মধ্যেই থাকতো রস, বুদ্ধিমত্তা, ছন্দ, কিংবা সমাজের কোনো একটি ঘটনা বা দৃশ্যের প্রতি ইঙ্গিত। এছাড়া স্বদেশি আন্দোলনকে এবং স্বদেশি শিল্পকে বেগবান করতে তিনি স্বেচ্ছায় দেশীয় পণ্যের জন্য বাণী লিখে দিতেন। যেগুলো বিজ্ঞাপন হিসেবেও ছিলো খুবই উপযুক্ত। এমনই একটি এন্ডোর্সমেন্টের উদাহরণ ছিলো ‘জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’র জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে।” কবিগুরুর দেয়া এই সার্টিফিকেট কেকের জন্য জনপ্রিয় ‘জলযোগ’-কে সুইটমিটের মার্কেট ‘পেনেট্রেশন’-এর সুযোগ করে দিয়েছিলো।

কবিগুরুঃ গোদরেজ সাবানের মডেল

আবার ‘লিপটন’ চা’য়ের জন্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো কবি’র কবিসত্তাকেই। তিনি লিখলেন-

“চা-স্পৃহ চঞ্চল

চাতকদল চল

কাতলি-জল তল

কলকল হে…”

লিপটন কোম্পানি এই কপি-প্রাপ্তি-পূর্বক যারপরনাই আহ্লাদিত ছিলো। একইসাথে কবির সাফাই আবার রসবোধ। দেশজুড়ে মুহূর্তে রটে গেলো ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ একজন বিশিষ্ট চা-প্রেমী। এরপর এলিট থেকে লোয়ার মিডল ক্লাস, সব সোশিও ইকোনোমিক ক্লাসের তৃষ্ণা মিটতে শুরু করলো শুধু লিপটন চায়েই। বস্তুত, কবিগুরুর এই যে সব শ্রেণিতে গ্রহণযোগ্যতা, এটা কিন্তু ‘সেলিব্রেটি’ জগতেও বিরল। এই গুণটির কারণেই সে সময় অসংখ্য বিজ্ঞাপনের সাথে তার নাম জুড়ে গিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইন্ডিয়ান অ্যাডম্যান প্রহ্লাদ কাক্কর-ও বলেছেন সে কথা। তিনি বলেছেন, “এখনকার দিনে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বাছাই করা হয় গণমানুষের কাছে কার কতোটুক গ্রহণযোগ্যতা তার বিচারে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এলিট থেকে লেইম্যান পর্যন্ত সবার কাছে ঢালাওভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি দু’টো নেই।”

বিশ্বকবির এন্ডোরসমেন্টে ধন্য হয়েছিল রেডিয়ম ক্রিমও

এই ইউনিভার্সাল এন্ডোর্সার ‘কুন্তলীন’-এর জন্য লিখলেন শুভকামনা-

“কেশে মাখ ‘কুন্তলীন’।

রুমালেতে ‘দেলখোস’।

পানে খাও ‘তাম্বুলীন’।

ধন্য হোক এইচ বোস।”

ওতেই শেষ নয়। নিজ স্বাক্ষর দিয়ে শেষে লিখলেন- “কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে।” এহেন সার্টিফিকেটের পর আর কী লাগে।

দেশীয় পণ্য রেডিয়াম ক্রিম এবং শ্রীঘৃতের জন্যও তাঁর লেখা বিজ্ঞাপনের চর্চা আজো হয়। শ্রীঘৃত সম্পর্কে তিনি লিখে দেন, “বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আশাকরি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে।” আর রেডিয়াম ক্রিম সম্পর্কে লিখেছিলেন, “রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।”

পরেরটা মেনে নেয়া আরেকটু কষ্টকর। যুগ যুগ ধরে সাবানের বিজ্ঞাপনে আমরা সুশ্রী নারীমূর্তি দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু ‘গোদরেজ’ ব্যবহার করলো কবি’র শ্মশ্রুমণ্ডিত ছবি। সাথে কবি’র নিজের লেখা লাইন- “গোদরেজের চেয়ে ভালো কোনো বিদেশি সাবানের কথা আমার জানা নাই। তাই আমি সবাইকে এটা ব্যবহার করতে বলবো।”

আর সুলেখা কালি’র বিজ্ঞাপনে তার ব্যবহৃত উপমা’র প্রয়োগের নমুনা নিঃসন্দেহে ‘এপিক’। সেই সময় লেখার জন্য বাজারে পাওয়া যেত ‘সুলেখা কালি’। বলপয়েন্ট কলম তখনও আসেনি। ঝর্ণা কলম বা ফাউণ্টেন পেন-এ এই কালি ভরে লোকে লিখতো। (শোনা যায়, ফাউন্টেন পেন থেকে এই ‘ঝর্ণা কলম’ নামটাও কবিগুরুর দেয়া। মতভেদ আছে অবশ্য)। ফাউন্টেন পেনের মার্কেট তখন ডমিনেট করছে বিদেশি কোম্পানি পার্কার-এর ‘Quink’ আর শেফার্স-এর ‘Skrip’। তুমুল কম্পিটেটিভ মার্কেট। আবার ফাউন্টেন পেনের জন্য ভালো কালি বানানো সহজ ছিলো না। কনজ্যুমার চাইতো কালি যাতে শুকিয়ে না যায়, নিব থেকে যাতে দীর্ঘসময় কালি ঝরে। আবার কালি যাতে ঝাপসা না হয়। তো সেইসব বিবেচনা করে ‘সুলেখা’ কালির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ‘কপি’ লিখলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।” সিম্পল। ট্যাগলাইন হিসেবেও দারুণ উৎরে যায়।  উপমার প্রয়োগ তো বেশ প্রশংসনীয়। এই এক কপি আর সাথে কবি’র নিজের এন্ডোর্সমেন্ট, দুইয়ে মিলে বাজারে ‘সুলেখা’ কালির ব্যবসা রমরমা।

কবিগুরু-ই শুধু নন, কপিগুরুও বটে। জন্মবার্ষিকীতে কবি’র প্রতি শ্রদ্ধা।

দ্য টেলিগ্রাফ এবং দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত আর্টিকেল অবলম্বনে